নৈঃশব্দ্যের কথাবার্তা

আলাপ সালাপ স্বগতঃ সংলাপ

জাবালে নূর

There has to be spiritual transformation among the masses, who have to be willing to recognize that their oppression is not a law of nature.

উপরের কথাটা নোম চমস্কির। লাতিন আমেরিকার দশকের পর দশক ধরে চলে আসা শোষণ নিপীড়ন আর নাগরিক বঞ্চনা, নারীদের ভোটাধিকার-সম্পত্তির অধিকার-চাকরি করার অধিকার, এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ‘সিভিল রাইটস’ আন্দোলন নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি এই কথাটা বলেছিলেন। একটা বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মিক/আধ্যাত্মিক/দার্শনিক পরিবর্তন আসতে হবে। জনগোষ্ঠীর ভেতরে যেন সবার মনে একই কথা (একটু এদিক ওদিক করে) ঘোরে, যেন সবাই একই জিনিস কামনা করে, যেন সবাই নিজেদের বন্দিত্বকে একইভাবে চিনতে পারে – সেই আন্দোলন আর সবকিছুর চেয়ে বেশি জরুরি। বাকি সমস্ত মিছিল মিটিং জ্বালাও পোড়াওয়ের এক পয়সা মূল্য নাই।

এই কথাটার জন্য গালি খেতে হবে। তাও বলছি। নব্বুইয়ের স্বৈরাচার পতন নিয়ে আমার চেয়ে বছর দশেক বড় যারা তারা সবাই খুব গর্ববোধ করেন। স্বৈরাচার পতন হয়েছিল। আচ্ছা, তারপর কী হয়েছে বলেন তো? কী ঘোড়ার ডিমটা ফলেছে? বিশ্ববেহায়াটা সংবিধানের বারোটা বাজিয়েছিল, ঠিক করতে পেরেছে কেউ? প্রথম যে সরকার এনেছিলেন সে সময়ের নাগরিকরা, সেই সরকারের আমলে গণ-আদালত বসেছিল, সেখানে শেষ বিচারে গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে ড্যাংড্যাং করে বেরিয়ে গেছে। ঠেকাতে পেরেছেন? বদলাতে পেরেছেন? পারেন নাই।

আমার বড়বেলায় দুটা আন্দোলন দেখেছি, একটা বুয়েটের ভিসিবিরোধী আন্দোলন, আরেকটা শাহবাগের গণজাগরণ আন্দোলন। প্রথমটা পুরোপুরি ব্যর্থ। দ্বিতীয়টা সাময়িক ও প্রাথমিক অর্জনের পর সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও ব্যর্থ।

এই তিনটা আন্দোলনের সব কয়টা কেন ব্যর্থ হলো? নানাজনে নানা কারণ বলবেন, আমার মতে সেগুলো সবই উপরি-কারণ। বাহ্যিক কারণ। ভাসাভাসা চোখে দেখলে সেগুলোকে ঠিক মনে হবে। এর বেশি ভাবতে গেলে আপনাদের মস্তিষ্ক ব্যথা করবে। আমি মনে করি এই প্রত্যেকটা আন্দোলন ব্যর্থ হবার পেছনে প্রধান কারণ এই সামগ্রিক দার্শনিক পরিবর্তনের অভাব। আমাদের কারোর মাঝে বদল আসে নাই। আমরা কোনো ব্যবস্থাকেই বদলাতে পারি নাই। এক স্বৈরাচার সরিয়েছি কিন্তু অন্য কেউ যেন স্বৈরাচার না হতে পারে আর কখনো – সেটা আমরা নিশ্চিত করি নাই। একটা ভিসি সরে নাই, ভাল কথা। পরের ভিসিগুলো যেন অমন না করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে পারি নাই। এক কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু তার বিনিময়ে আরো কয়েকজন ব্লগার খুন হয়েছে। দেশে চুপচাপ ইসলামিক জঙ্গিবাদের বাম্পার ফলন ঘটেছে – আমরা সেটাকে চিহ্নিত করে বাতিল করতে পারি নাই।

আমাদের কোনো একটা ব্যবস্থাকেও ঠিক করতে পারি নাই – রাজনৈতিক, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, সামাজিক – প্রত্যেকটা ব্যবস্থা নষ্টভ্রষ্ট। আজকে শিশুরা রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদেরকে সবাই বাহবা দিচ্ছেন। তারা রাজনৈতিক বা দার্শনিক প্রজ্ঞা ধারণ করে না। তা, আপনি করেন? এই আন্দোলনের ফলাফল কেমন আশা করেন? কী কী বদল ঘটবে? এখন যদি বলেন, কিছুই বদলাবে না তবু একটু ভাঙচুর হলো, সবাই জানলো যে আমরা আছি, তাহলে আপনি সেই তৃপ্তি নিয়ে হাল্কা মুতে শুয়ে পড়েন।

দুঃখিত এমন ভাষায় কথা বলার জন্য। কিন্তু এমন অবিমৃশ্যকারিতা দেখে মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল। আপনি কি ভাবছেন আপনার একারই আবেগ আছে, আপনার আবেগ কি যাদের সন্তান মারা গেছে তাদের চেয়েও বেশি? আবেগ দিয়ে কাচকলাটাও হয় না। ওটা বাদ দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা হলে চিন্তা করেন। গত কয়েকদিন ফেসবুকে ডাঃ মণীষার পক্ষের প্রচারণা দেখেছি। আজকে ভোটকেন্দ্রগুলোতে কী হয়েছে দেখেছেন তো? যারা গিয়ে মণীষাকে আঘাত করেছে, ভোট চুরি করেছে, এক দলের স্লোগান দিয়ে নাকি অন্য দলের ব্যালট ভরেছে – এরা আপনার আমার ভাই। এই ভাইদের পারলে লাইনে আনেন। তারপর সবাই মিলে আঙুল তুলে ‘বি কেয়ারফুল’ বলা মাস্তানকে হঠাতে পারবেন। আপনাকে তখন আলাদা করে কিছু করতে হবে না, সবাই মিলেই করবে।

আজকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের সব অভিভাবকের কাছে ক্ষুদেবার্তা গিয়েছে – আপনার সন্তানকে সামলান, সে এই আন্দোলনে গেলে তাকে বহিষ্কার করা হবে। এই বার্তাকে উপেক্ষা করে যদি সব অভিভাবক কালকে তাদের ছেলে মেয়েকে আন্দোলনে পাঠান, আদমজী কি সবাইকে বহিষ্কার করবে? কিন্তু তা ঘটবে না। কারণ উপরে নোম চমস্কি বলে দিয়েছেন। এই আপামর জনসাধারণের মধ্যে এই চেতনা নাই যে কোনো স্কুলের অধ্যক্ষ এভাবে অভিভাবকদের শাসাতে পারে না। তারা যে বন্দী, নিপীড়িত, সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাই। সুতরাং বাকি কয়েকজন মিলে রাস্তায় নেমে কোনো লাভ নেই। যারা নামবেন, তারা মার খাবেন, মারা যাবেন। বাকিরা সুখে বার্গার চিবাতে চিবাতে সেলফি তুলবে।

আমাদের প্রতিটা আন্দোলন গুটিকয় মানুষের, সেই মুক্তিযুদ্ধ থেকেই। তার আগেও অমনই ছিল। সামগ্রিক জাগরণ আমাদের আসে নি, তাই আমাদের মাঝে ধারণা নেই যে নাগরিক মানে কী, দেশ মানে কী, জাতি মানে কী, সরকার মানে কী। এগুলো ধারণা নাই বলে অন্যায় হয়, আমরা তড়পাতে তড়পাতে কয়েকটা বাস পুড়াই, তারপর পুলিশ আর র‍্যাবের ঠ্যাঙানি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই পরের ঘটনা পর্যন্ত।

প্রলম্বিত নরক

গুলশানে আইসিসের জঙ্গি আক্রমণের দুই সপ্তাহ পূর্ণ হলো আজ।

খবরের কাগজে নিহতদের ময়না তদন্তের রিপোর্ট এসেছে। জঙ্গিরা কীভাবে হত্যা করেছে, কতটা পাশবিক নির্যাতন করে মেরেছে তা পড়লাম। আমি খুব শক্ত স্নায়ুর মানুষ। কিন্তু এই রিপোর্ট পড়ে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। হলি আর্টিজান বেকারিতে যারা খুন হয়েছেন, তারা রক্তমাংশের মানুষ ছিলেন। তাদের পরিবার ছিল। বন্ধুবান্ধব ছিল। ভালোবাসার এবং ঘৃণার মানুষ ছিল। তাদেরকে কীভাবে একটু একটু করে মারা হয়েছে সে বর্ণনা পড়তে গিয়ে বিচলিত হয়েছি। নির্বিকার  থাকতে পারি নি। সবচেয়ে বেশি আঘাত করা হয়েছে নারীদের। তাদের সারা শরীরে চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। বাংলাদেশি ছাত্রীটির মাথায় ভারি কোনকিছু দিয়ে আঘাতের লক্ষণ আছে। ভারি কিছুর আঘাত অর্থাৎ সম্ভবত তার মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছিল। সকলের শরীরে, হাতে, পেটে, বুকে ছুরির আঘাতের চিহ্ন আছে। একজন নারীর পেটে ও বুকে তিরিশবার ছুরির কোপ আছে। তিরিশবার! একজন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে আঘাত করার পাশাপাশি তার পেটে থাকা শিশুকেও আঘাত করা হয়েছে। সাত মাসের শিশুর চেহারার আদল বোঝা যায়। মায়ের জঠরের ভেতর মাতৃকা রসে মাখামাখি শিশু নড়ে চড়ে বেড়ায়, মাঝে মাঝে মায়ের পেটে লাথি দেয়। আলট্রাসনোগ্রামে দেখা যায় সে ঘুমের ভেতরেই চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসছে, মাঝে মাঝে পায়ের আঙুল নাড়াচ্ছে, চিকন হাত দিয়ে নিজের মুখে বোলাচ্ছে। মায়ের ভেতরে নিরাপদে, নিশ্চিন্তে ঘুমুতে থাকে এই শিশুকেও ছুরি আর চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।আর শেষ পর্যন্ত এদের বিশ জনকেই জবাই করা হয়েছে। রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝের ছবি আমরা দেখেছি। সেই রক্তে উপুড় ও কাত হয়ে থাকা নিথর লাশের ছবি দেখেছি। এই লাশগুলো কিছুক্ষণ আগেই হাসিখুশি জীবন্ত মানুষ ছিলেন। এরা এক ছুটির দিনের সন্ধ্যায় খেতে গিয়েছিলেন হলি আর্টিসানে। যেমন আমরা সকলেই যাই। তারা কোন যুদ্ধে যান নি, তেমন কোন খবরও পান নি যে দেশে যুদ্ধাবস্থা। কোন আগাম-সংকেত পান নি যে অচিরেই তাদেরকে কোরবানির পশুর চেয়েও নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হবে।

আমাদের সম্মিলিত মননে এগুলো সম্ভবত আর কোন দাগ কাটে না। বলছি  – কেননা মাত্র দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে ফিরে গিয়েছি। মাঝে অবশ্য ঈদের লম্বা ছুটি থাকায় এসব ভুলতে সুবিধা হয়েছে। ঈদে আমরা নামাজ পড়ে পরিবারের সাথে ঈদ পালন করেছি, ঘুরতে গিয়েছি অনেকেই। আমরা টিভির বিভিন্ন চ্যানেলের নাটক দেখে সেগুলো নিয়ে মতামত দিয়েছি! কোন নাটকটি ভাল বানিয়েছে, কোন চ্যানেলে নাটকের মাঝে বেশি বেশি বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেছি, এত বেশি বিজ্ঞাপন দেখায় বলেই নাকি জঙ্গি হয়! কী নিষ্ঠুর অসংবেদনশীলতা! কী অকল্পনীয় অমানবিকতা! মনে হচ্ছে আমরা বোকাবাক্সের সামনে বসে থাকা জাবর কাটা গবাদি পশুবিশেষ। যারা কেবল নিষ্পলক টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকি মিডিয়া পর্নোগ্রাফি। দেখতে থাকি জঙ্গিদের বাবা-মায়ের অশ্রু – আহা রে, তার এত সুন্দর চেহারার ছেলেটি ভুল বুঝে ভুল করে জঙ্গি হয়ে গেছে। একটু ভালোবাসা, একটু সহমর্মিতা পেলেই হয়তো তারা জঙ্গি হতো না। এগুলো দেখি আর শুনি আর মাথা নেড়ে একমত হই। অথবা আমরা ক্রাশ খাই এইসব জঙ্গিদের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি দেখে! আমাদের মিডিয়া বারবার তাদের আইসিসের কালো পতাকার সামনে বন্দুক হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিগুলো পুনরুৎপাদন করতে থাকে। এরই মাঝে জাকির নায়েকের মতো একটি আধুনিক ভণ্ড পীরের চ্যানেল নিষিদ্ধ করায় যে যার সুবিধামতোন ফেসবুক উত্তপ্ত করেছি। ধারণা করি যে, এতে কর্তাব্যক্তিরাও খুশি হয়েছেন। ভালই হয়েছে, জঙ্গিবাদের ঘটনায় একটি চমৎকার কাকতাড়ুয়া পাওয়া গেছে! এটাকে ঝুলিয়ে রাখলে জঙ্গি পাখিরা হয়তো আর ক্ষেতে হানা দিবে না। আর আমরা ক্ষেতের অধিবাসীরাও নিশ্চিন্তে রাতে ঘুরতে যেতে পারবো যমুনা ফিউচার পার্কসহ বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়। একপক্ষে জাকির নায়েকের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছেন কেউ কেউ, অন্যপক্ষে জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন বাকিরা। এক ভ্রূক্ষেপহীন প্রবল উৎসাহে আমরা তর্কে মেতে উঠেছি জাকির নায়েককে নিয়ে, হয়তো এই তর্ক থেকেই আমরা প্রমাণ করে দিব যে দেশে জঙ্গিসমস্যার সমাধান একমাত্র আমার কাছেই আছে! প্রথম দলটি জাকির নায়েকে সমস্যা দেখেন না, বরং অন্যান্য আরো অংশের মধ্যেই জঙ্গিবাদের মূল আছে বলে মনে করেন। দ্বিতীয় দলটির মতে একমাত্র জাকির নায়েকের পিস টিভিতেই লুকিয়ে আছে প্রাণভোমরা। হয়তো আমাদের দুই দলের জন্যই জাকির নায়েকে মনোযোগ দেয়াটা সুবিধাজনক। কারণ আমরা জঙ্গিবাদ সরীসৃপের পিচ্ছিল শরীরে হাত রাখতে ভয় পাই।

ধরে নিচ্ছি সবাই এত সহজে মানিয়ে নেন নি। কেউ কেউ হয়তো এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে আসলেই প্রভাবিত হয়েছেন, নাড়া খেয়েছেন। তাদের জন্য এই লেখা। অতি বেদনার সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, “ওয়েলকাম টু দ্যা ক্লাব”। আপনি যদি গত দেড়-দুই বছরের জঙ্গি হত্যাগুলোতে প্রভাবিত না হয়ে থাকেন, এবং এতদিনে গুলশানের ঘটনায় বিচলিত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে স্বাগতম জানাই “প্রলম্বিত নরকে”। আমরা গত দেড়-দুই বছর ধরেই এই প্রলম্বিত নরকে বসবাস করছি। আপনি নতুন যোগ দিলেন। প্রথমেই এই নরকের চারপাশটুকু চিনিয়ে দেই। এই নরকে পৃথিবীর কদর্যতম ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। এখানে আপনি কিছুদিন থাকলে সেগুলো দেখতে পারবেন। দেখবেন কীভাবে কর্তাব্যক্তিরা এসব খুনকে ধামাচাপা দিচ্ছেন। দেখবেন কীভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ছেলে, তাঁর ক্যাবিনেট, তাঁর দল, তাঁর পুলিশ, তাঁর গোয়েন্দারা ধীরে ধীরে নিহতদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন। জানতে পারবেন “ঠাকুরঘরে কে রে, আমি কলা খাই না”র ঢঙে তিনি ও তার সম্পর্কিত সকলেই বলছেন ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম, জঙ্গিরা আসলে মুসলমানই নয়! দেখবেন কীভাবে কিছু কিছু দলীয় বুদ্ধিজীবী নানাভাবে সেই অবস্থানের জাস্টিফিকেশন করছেন। এঁদের কাউকে কাউকে হয়তো আপনি আইডল ভাবতেন, ভরসাস্থল ভাবতেন। এখন তাঁদের কলাম আর অপিনিওন পিস দেখতে তাঁদের মুখের ওপর মুতে দেয়ার অক্ষম ইচ্ছা করবে আপনার।

তারপর দেখবেন সবাই যে যার বলয়ে ফিরে গেছেন। নির্লজ্জের মতন নিজ জীবনের তুচ্ছ অর্থহীন ভোগ আর বিলাসের প্রচার করছেন। দেখবেন হাজার হাজার সেলফি আর লক্ষ লক্ষ চেকইন। আপনিও হয়তো একসময় নির্লজ্জ হয়ে তাদের লাইক দিয়ে বেড়াবেন। সমস্যা নেই। তবে এই নরক থেকে বের হতে পারবেন না। কোন কোন রাতে ভয়ানক দুঃস্বপ্নের ভেতরে দেখবেন আপনার বন্ধুর হাসি হাসি মুখের ওপরে এসে চাপাতি দিয়ে কোপ দিচ্ছে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা কয়েকজন। এই দুঃস্বপ্ন দেখে আপনার ঘুম ভেঙে যাবে। রক্তব্যাকুল চোখের সামনে সেই পরিচিত বন্ধুর রক্তমাখা বিকৃত মুখের হাসি ঝুলতে থাকবে।

বুদ্ধিজীবীদের এড়াতে পারলেও আপনার ফ্রেন্ড লিস্টের “বন্ধুদের” এড়াতে পারবেন না। এরা একেকজন বিভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে মতামত দিবেন। একজন নাস্তিক এসে বড় একটা স্ট্যাটাসে আচ্ছাসে ধর্মকে ধুয়ে দিবেন। একদম তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের আলাপ। সেই আলাপে যত না আইসিসের জঙ্গিবাদ ঠেকানোর বা চিহ্নিত করার চেষ্টা, তার চেয়ে বেশি কতগুলো বই পড়ে তিনি নাস্তিক্যবাদ শিখেছেন সেই বারফাট্টাই। ওদিকে আসবেন একজন তথাকথিত মডারেট মুসলিম, যার তালগাছ হলো ইসলাম ধর্ম একটা শান্তির ধর্ম। যে যাই বলো এই ধর্ম নিয়ে কিছু বলা যাবে না। এমনকি আইসিস যে এই ধর্মের অনুসারী, সেটা বললেও তিনি গোস্বা করবেন। এরপর আরেকজন আসবেন যিনি কট্টরভাবেই ইসলাম ধর্ম মেনে চলেন। আপনার দুর্ভাগ্য বেশি হলে, ইনি একজন সরব মুসলিম। যিনি কোরান-সুন্নাহর জিহাদী আয়াত ও বাণীর মডার্ন ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে চলেন। তার বর্ণনা পড়ে প্রমথ চৌধুরির “সাহিত্যে খেলা” অথবা বঙ্কিমচন্দ্রের “রচনার শিল্পগুণ”কেও জলবৎ তরলং মনে হবে। আপনার সন্দেহ হবে, এই বন্ধু রবীন্দ্রনাথের “সোনার তরী” কবিতারও নতুন কোন ইন্টারপ্রিটেশন বের করে ফেলতে পারে! এমন নানাবিধ বন্ধুর চাপে আপনার ত্রাহি মধুসূদন দশা। তখন মনে হবে এর চেয়ে বিশ্বচরাচর-অগোচর নির্বোধ বন্ধুটির সেলফিগুলোই বরং ভাল ছিল।

যত যাই করুন না কেন, এই প্রলম্বিত নরক থেকে আপনার মুক্তি নেই! গুলশানের জঙ্গিগুলোর প্রতি ফেটিশাক্রান্ত আবেগ থেকে যে ছোট বরফের কুণ্ডে আপনি পেঁচিয়ে যাচ্ছেন, সেই বরফখণ্ড ধীরে ধীরে বড় হবে! আপনি জানবেন অপারেশন থান্ডারবোল্টের অনেক আগেই বিশজন নিরীহ মানুষকে জঙ্গিরা কুপিয়ে মেরে ফেলেছিল। আপনি জানবেন একেকটি নারীর লাশে তারা বারবার ছুরি দিয়ে কুপিয়েছে। আপনি দেখবেন নিহতদের একজন আদৌ আক্রান্ত নাকি জঙ্গি সেটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে, কারণ তার নানা একটা পত্রিকার মালিক। আপনি আরো দেখবেন শত শত তরুণ জঙ্গিদের মতই ঘরছাড়া নিখোঁজ। আপনি দেখবেন কীভাবে সরকারের পাশাপাশি জঙ্গিদের বিশ্ববিদ্যালয় তাদের হাত ধুয়ে উঠে পড়ছে। দেখবেন একে একে সকলেই এপোলজেটিক হয়ে উঠছে। প্রবল এপোলজিতে ভরে উঠবে আপনার চারপাশ। কেউ তার ধর্ম নিয়ে, কেউ তার বন্ধু নিয়ে, কেউ তার সন্তান নিয়ে, কেউ তার বড়ো ভাই নিয়ে, কেউ তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে দিকে দিকে এপোলজেটিক কথা বলছে। কেউ জঙ্গির দায় নেয় না। প্রধানমন্ত্রী নেয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নেয় না। আইজিপি পুলিশ নেয় না। বুদ্ধিজীবী নেয় না। শিক্ষক নেয় না। অভিভাবক নেয় না। পিতামাতা নেয় না। বিশ্ববিদ্যালয় নেয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাইরা নেয় না। মডারেট মুসলমান নেয় না। প্র্যাকটিসিং মুসলমান নেয় না। ধর্ম নেয় না। পরিবার নেয় না। সমাজ নেয় না। সম্ভবত স্রষ্টার সাক্ষাৎকার নিলে দেখতেন তিনিও নিচ্ছেন না!

মজার ব্যাপার কি জানেন। এই গুলশানও আবার ফিরে ফিরে আসবে। প্রতিটি গলাকাটা লাশের ওপর আরেকটি নতুন লাশ জমা হবে। প্রতিটি নতুন লাশের পর একই চক্র। সেই লাশের পিছু পিছু আমাদের প্রলম্বিত নরকে আপনার মতই আরও নতুন সদস্য যোগ দিবেন। তাই এখনই হাল ছেড়ে দিয়েন না, বস! সামনে আরো দীর্ঘ দীর্ঘ ঋতুকাল আমাদের এই প্রলম্বিত নরকে কাটাতে হবে। টাইট হয়ে বসেন। মাঝে মাঝে বেশি কষ্ট হলে এই নরকের মাটিতে মুখ গুঁজে কণ্ঠের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করবেন। দেখবেন একসময় ক্লান্ত হয়ে শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। ক্লান্তির মেঘের ওপর দুঃস্বপ্নহীন কয়েক মুহূর্তের ঘুম পেতে পারেন – ওটুকু বোনাস।

প্রলম্বিত নরকের অনন্ত ঋতুতে আপনাকে স্বাগতম! ভাল থাকবেন!

চড়

গতকাল চট করে আড্ডা বসেছিল। সন্ধ্যায় বাইরে খেতে ইচ্ছা করছিল। কয়েকজন মিলে পপাই’স-এ গেলাম। বড়ো একটা চিকেন বাকেট নিয়ে সবাই বসে গেলাম খেতে। বাইরে সারাদিন সূর্য হিট ইনডেক্সে লাফালাফি করছিল, সাথে ছিল ভ্যাপসা গুমোট গরম। ভাগ্য ভাল গাড়ির নষ্ট এসি আবার কাজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু বাসা বা গাড়ি থেকে বের হলেই দরদর করে ঘামছিলাম। পপাই’স খুব ঠাণ্ডা করে রেখেছিল। চিকেন চিবানো হলে বললাম বাসায় বসে একটু চা খেলে ভাল হয়। সবাই রাজি হলো। আড্ডার এক পর্যায়ে কথা ঘুরে রাজনীতি আর ধর্মের দিকে চলে গেল। সবাই দেশের পোলারাইজড অবস্থা নিয়ে হতাশ। সবকিছুই চরমে, ধর্মের নামে কুসংস্কার আর পর্দা মানা বেড়ে গেছে, আবার অন্য দিকে মেয়েদের আঘাত করা, আক্রমণ করাও বেড়ে গেছে। আমি যদিও অতোটা হতাশ হতে পারছিলাম না। আমি বলছিলাম, এই পোলারাইজেশন তো হবারই কথা ছিল। জামাত-শিবির গত ২০-২৫ বছর ধরেই এটা করছে। হবে না কেন? এখন আমরা সেই প্রচেষ্টার সুফল(!) দেখতে পাচ্ছি। আমাদের প্রচেষ্টাগুলোকেও এরই মধ্যে ধরে রাখতে হবে। আরও ২০-২৫ বছর পরে সেটার প্রভাব দেখা যাবে। কেউ মানছিল না। আরও কিছুক্ষণ তর্ক+আড্ডা চললো। তারপর আম্মা ফোন করায় আসর ভেঙে উঠে পড়লাম। রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় তিনটা-সাড়ে তিনটা বাজলো।

তারপর আটটার দিকে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে দেখি আরেকজন ব্লগার নিলয় নীলকে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মনে হলো গতরাতে তর্ক করার জন্য গালে কেউ সপাটে চড় মেরেছে।

বিজ্ঞান ও ধর্মের সেতু-সম্পর্কিত চারটি সহজ টোটকা

এক.

এই পোস্টটি চর্বিত-চর্বন মনে হতে পারে। একটি অতি-পুরাতন বিতর্ককে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। ইব্রাহিমীয় ধর্মের অনুসারীদের সাথে বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রায়শই কিছু বিষয় ঘুরে-ফিরে আসতে থাকে। অনেকবার অনেকভাবেই বিবর্তন-অজ্ঞদের এসকল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, বিভ্রান্তি দূর করে সঠিক সত্যটি জানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও তর্কগুলো শেষ হয় না। নতুন নতুন আঙ্গিকে পুরানো প্রশ্নই উত্থাপিত হতে থাকে। এজন্যই হয়তো কবীর সুমন গেয়েছেন, “প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা…

সেদিকে যাচ্ছি না। সম্প্রতি ফেসবুকে মাশরুফ হোসেন বিবর্তন, বিজ্ঞান এবং ধর্ম সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেখানে আলোচনা যখন সমাপ্ত হলো আর সবাই নিজ নিজ তালগাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন, তখন পুরো আলোচনাটি আবার পড়লাম। পড়ে ভাবলাম একটু অন্য আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা যায় কি না। প্রথমেই মূল লেখাটি পড়ে নেয়া যাক। স্ট্যাটাসদাতার অনুমতিসাপেক্ষে পাবলিক স্ট্যাটাসটি হুবহু নিচে তুলে দিচ্ছি।

দুহাজার পনের সালে এসে এই শিরোনামে একটি লেখা লিখবার মানে একটাই, এদেশের বিজ্ঞানমনস্কতার অবস্থা শোচনীয়। তাও লিখতে হচ্ছে, কারণ বিবর্তনবাদকে “শুধুমাত্র একটা থিওরি, এটা নিউটনের সূত্রের মত মেনে নেবার কোন কারণ নাই” বলার মত লোকের সংখ্যা অগণিত। প্রচন্ড লজ্জার বিষয়, এই কথাটা বলে মূলতঃ ছদ্মশিক্ষিতরা, সার্টিফিকেট থাকলেও জ্ঞান যাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি। এদের মধ্যে মেডিকেল স্টুডেন্ট থেকে শুরু করে কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র‍্যাজুয়েট করা সায়েন্স টিচারও আছে।
বাংলাদেশী আমেরিকান বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার ঋতু সরকার আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখা সবচাইতে আলোকিত মানুষদের একজন। অসামান্য ধীশক্তির অধিকারী এই তরুনী সম্প্রতি আমার একটি পোস্টে এই “থিওরি বনাম ল” ডিবেট এর একেবারে পরিপূর্ণভাবে সমাপ্তি টেনেছে। Sauropod Fossil এর উপর ভিত্তি করে সর্বপ্রথম ত্রিমাত্রিক প্রিন্টেড রবোটিক ডায়নোসর প্রজেক্টে কাজ করে আসা ঋতু যে ওর বিষয়ে প্রচন্ড দখল রাখে, তা ওর কথাতেই বোঝা যায়। ওর সুদীর্ঘ কমেন্টের কিছু অংশ বাদে বাকি সারসংক্ষেপই হচ্ছে আজকের স্বচ্ছচিন্তা:
নিউটনের সূত্র কাজ করে সীমিত পদার্থ সংক্রান্ত পরিবেশে। পরিবেশ যখন অসীম এবং আমরা যখন আলোর গতি নিয়ে পরীক্ষা করছি, তখন নিউটনের সূত্র(Law) কাজ করেনা, আইন্সটাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (Special Theory of Relativity) ব্যবহার করতে হয়। কাজেই , থিওরি আর সূত্র নিয়ে এত কচলাকচলির কিছু নেই। এই দ্বিধা ক্লাস সিক্সের বাচ্চার থাকতে পারে, ন্যূনতম বায়োলজি জানা কোন ধাড়ী খোকার নয়।
নিউটনের মত ডারউইনেরও সীমাবদ্ধতা আছে। ডারউইন তাঁর থিওরি দিয়েছিলেন গালাপাগোস দ্বীপের পর্যবেক্ষণ থেকে, সেখানের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তিনি কিছু নতুন ধারণার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন তাঁর তত্ত্বের কিছু কিছু জিনিস মিলছেনা( যেটা নিয়ে ত্যানাবিদেরা ত্যানা প্যাঁচায়)। এর কারণ, ডারউইন Gene এবং Mutation সম্পর্কে জানতেন না। এ কারণে তিনি তাঁর তত্ত্ব পুরোপুরি প্রমাণ করে যেতে পারেননি, যেটা আমরা পারি। ডারউইনের সময় গুগল এবং ইমেইল থাকলে মেন্ডেল তাঁকে সহায়তা করতে পারতেন এবং দুজন মিলে ফাঁকগুলো ভরাট করতে পারতেন।
মেন্ডেলের জেনেটিক্স একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও স্টার্টিং পয়েন্ট হিসেবে দারুন। এ যুগে আমাদের হাতে অকাট্য সব প্রমাণ আছে, যা ক্ষুদ্র (জেনেটিক্স এবং বায়োকেমিকেল ডাটা) ও বৃহৎ (ফসিল এবং জীবন্ত প্রাণী) দুই ক্ষেত্রেই সন্দেহাতীতভাবে বিবর্তনবাদকে প্রমাণ করে এবং ক্রিয়েশনিস্ট থিওরিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
কাজেই, ধর্মকে এর স্পিরিচুয়াল জায়গায় রাখুন, আত্মিক উন্নতিতে এর সহায়তা নিন। বিজ্ঞানের নিক্তি দিয়ে ধর্মকে জায়েজ করতে গেলে শুধু নিজেকেই নন, যে ধর্মকে আপনি জায়েজ করতে যাচ্ছেন সেটাকেও হাসির খোরাক বানাবেন।
ঋতুর বক্তব্য এখানেই শেষ, আমাদের চিন্তার শুরু।
অন্ধকার কেটে যাক জ্ঞানের আলোয়!

এবারে আসি মন্তব্যের ঘরে। স্বভাবতই বিতর্কিত বিষয় বলে এই পোস্টে প্রায় তিনশতাধিক মন্তব্য হয়েছে। বাকি সমস্ত মন্তব্য বাদ দিয়ে আমি যে তর্কে অংশ নিয়েছি সেটুকুতে ফোকাস করবো। মূল পোস্টের কিছু পরেই একজন প্রশ্ন তুললেন, ধরি তার নাম “বিবর্তন-সন্দিহান“।

বিবর্তন-সন্দিহানঃ

১. আপনার পোস্টে কীভাবে ক্রিয়েশনিস্ট থিওরি বানচাল হলো? বিবর্তন সত্যি হলেও প্রথম প্রজাতিটা তো কোন না কোনভাবে সৃষ্টি হয়েইছিল, নাকি? সবকিছু শূন্য থেকে এসে, তাহলে শূন্যটা কোথা থেকে এলো?
২. ফসিল থেকে বিবর্তন তত্ত্বকে প্রমাণ করার কাজটা বিজ্ঞানের কোন প্রজেক্টে হয়েছে?
৩. এই তত্ত্বকে নিউটন আর আইনস্টাইনের সাথে মেলাবেন না, কারণ নিউটনের তত্ত্বের প্রমাণ আমরা দৈনন্দিন জীবনেই দেখতে পাই। আর আইনস্টাইনের তত্ত্বকেও আণবিক শক্তি তৈরির সময় ব্যবহার করে প্রমাণ করা গেছে।
৪. আপনি যে বললেন, “এই কথাটা বলে মূলত: ছদ্মশিক্ষিতরা” এটা আসলে ঠিক না। কারণ এমন অনেক বিজ্ঞানীই আছে যারা এর ব্যাপারে সন্দিহান, আর তারা আপনার চেয়ে বেশিই জানেন। আপনি তাদেরকে ছদ্মশিক্ষিত বলতে পারেন না।
৫. জিন এর কোডিং আর ফসিল কীভাবে বিবর্তন তত্ত্ব প্রমাণ করে সেটার লিংক দিবেন আশা করি।

এই প্রশ্নগুলো আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। অত্যন্ত “যুক্তিযুক্ত” প্রশ্ন। বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের সাধারণ জ্ঞান অতি সীমিত, প্রায় নেই বললেই চলে, আর সাথে আছে প্রচলিত ভুল- ও মিথ্যা-বয়ান। একজন এগিয়ে আসলেন উত্তর দিতে-

উত্তরদাতা১- “বিবর্তন-সন্দিহান, আমরা তো অহরহই বিবর্তনের প্রমাণ দেখছি। অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া অথবা কীটনাশক-রেজিস্ট্যান্ট কীটপতঙ্গের কথা শুনে থাকবেন নিশ্চয়ই। এছাড়াও হালকা রঙের মথ পাওয়া যায়, যেগুলো শিল্পবিপ্লবের পরে ছাইরঙা হয়ে গেছে।”
বিবর্তন-সন্দিহানঃ “কিন্তু এই ঘটনাগুলো দিয়ে তো সৃষ্টির উৎপত্তিকে নাকচ করা যায় না। আর এগুলো প্রমাণ ঠিক শক্তপোক্ত নয়। কারণ নইলে এই “থিওরি” সবাই গ্রহণ করে নিতো। মথের রঙবদল শিল্পবিপ্লব থেকে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটতে পারে, যেমন তেজস্ক্রিয়তা থেকে অনেকের ক্যান্সার হয়।”
উত্তরদাতা১- “শক্তপোক্ত না কে বলেছে? বহু-প্রতিষেধক-রোধী যক্ষা একটা ভয়ানক রোগ, ভারতকে জিজ্ঞেস করে দেখেন। মথের রঙ তেজস্ক্রিয়তার কারণে বদলায় না। শিল্প-কারখানা থেকে আসা ছাইয়ের সাথে ক্যামোফ্ল্যাজ নিতে মথের জিন “নির্বাচন-চাপ” থেকে এই রঙ বেছে নেয়। মানুষ বিবর্তনকে মেনে নিতে পারে না কারণ ইব্রাহিমীয় ধর্মে আদম ও ইভকে প্রথম মানব-মানবী বলা হয়েছে। এরকম অনেক কিছুই যেমন সমকামীদের বিয়ের অধিকার মানুষ মেনে নিতে চায় না কারণ ধর্মে নিষেধ করেছে। কিন্তু তারপরও সমকামীরা ঠিকই বিয়ে করছে।”
বিবর্তন-সন্দিহানঃ “হাসালেন। আমি “মানুষ” নিয়ে কথা বলছি না, আমি বিজ্ঞানীদের কথা বলছি। গুগল করেই দেখেন কতজন বিজ্ঞানী এই “থিওরি”কে মেনে নিয়েছেন আর তাদের মধ্যে কতজন বিশ্বাসী। আর হ্যাঁ, এই পরিবর্তনগুলো ভৌগলিক কারণে হয়েছে নাকি বিবর্তনের কারণে, তা পরিষ্কার না। পরিবেশ বদল, তেজস্ক্রিয়তা এসব কারণেও এমন পরিবর্তন ঘটে। এটা বিবর্তন না। আর তারপরেও মোদ্দা কথা থেকেই যায় যে বিবর্তন সৃষ্টিতত্ত্বকে বাতিল করতে পারে না।”

এই পর্যায়ে আমি বিবর্তন-সন্দিহানের সাথে সরাসরি আলোচনায় যোগ দিলাম। খেয়াল করলাম, “থিওরি” বলতে তিনি বিজ্ঞানের ভাষাকে অনুসরণ করছেন না। বিজ্ঞানের ভাষায় থিওরি বা তত্ত্ব একটি পুনঃপুনঃপরীক্ষিত বিষয়, তিনি “থিওরি” বলতে “হাইপোথিসিস” বুঝাচ্ছেন, যা আদতে একটি প্রস্তাবনা যা এখনো সম্পূর্ণরূপে (তথ্য-উপাত্ত-পরীক্ষণ দ্বারা) প্রমাণিত হয় নি। এছাড়াও খেয়াল করলাম তিনি বিবর্তন বিষয়ে সন্দিহান, তাই প্রথমেই সেই সন্দেহের ভিত্তিটিকে বুঝে নিতে চাইলাম, “বিবর্তন-সন্দিহান, দয়া করে একজন বিজ্ঞানীর লিখিত পিয়ার-রিভিউড জার্নাল দেখাতে পারবেন যিনি বিবর্তনকে মিথ্যা/সঠিক না/ঘটে নি বলে দাবি করেছেন এবং প্রমাণ করে দেখিয়েছেন?”

উত্তরে বিবর্তন-সন্দিহান বললেন, “আপনি দয়া করে একজন বিজ্ঞানীর লিংক দেখান যিনি এটাকে সত্যি বলে প্রমাণ করেছেন”।

[স্বভাবতই, প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন আসলে কালক্ষেপণ ছাড়া কিছু না। তাই একটু বিরত হলাম।]

এরই ফাঁকে উত্তরদাতা১-এর সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বিবর্তন-সন্দিহান এমন একটি কথা বললেন, যা থেকেই এই পোস্টের অবতারণা!

উত্তরদাতা১- “যিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনই বুঝেন না, তার সাথে বিবর্তনের সত্যমিথ্যা নিয়ে আলাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব না! হাল ছাড়ছি।”

বিবর্তন-সন্দিহানঃ “প্রাকৃতিক নির্বাচন তো বিবর্তনেরই একটি প্রক্রিয়া, আর আমি বিবর্তন নিয়েই সন্দিহান। তাই আমি প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়েও সন্দিহান। যা বলছিলাম, ওসব পরিবর্তনের পেছনে তেজস্ক্রিয়তা বা অন্য কোন কারণ যে নেই তা কেউ প্রমাণ করে দেখাতে পারে নি। আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করি, বিবর্তন ইসলামের বিরুদ্ধে যায়, এজন্য কিন্তু আমি তর্ক করছি না। কারণ একটা সম্ভাবনা আছে যে ইসলাম বিবর্তনকে সমর্থন করে, এমনকি অনেক ইসলামী পণ্ডিতও এটা সমর্থন করেন। হতে পারে আদম ও হাওয়ার আগেও সৃষ্টি ছিল, হতে পারে আদম এবং হাওয়া পৃথিবীতে মিলিত হবার পর থেকেই বিবর্তন শুরু হয়েছে। আমি তর্ক করছি কারণ বিবর্তন তত্ত্বটি নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।”

বোল্ড করা লাইনগুলো আজকে আবার পড়তেই একটু থমকে গেলাম। একটু চিন্তা করা দরকার এখানে। চলুন, বিবর্তন-সন্দিহানের কথার পেছনে উদ্দেশ্যকে সৎ ধরে নিয়েই এই অবস্থানটিকে একটু বিশ্লেষণ করি। তিনি আস্তিক, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন, এবং ধার্মিক, অর্থাৎ ধর্মগ্রন্থের নিয়ম-কানুন মেনে চলেন বা চলার চেষ্টা করেন। আর দশজনের মতোই ধর্মের সকল বিষয়কেই তিনি সত্য ভাবেন, মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। এ নিয়ে আমার আসলেই কোন বিরোধিতা নেই। আমার মতে প্রত্যেক মানুষেরই অন্যের কোনরূপ ক্ষতি না করে নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস ও বিশ্বাস পালনের অধিকার আছে। এটাও পরিষ্কার যে বিবর্তন-সন্দিহান বিজ্ঞানের প্রতি অনুকূল ভাবনা পোষণ করেন। তিনি তাদের দলেও পড়েন না, যারা ধর্মের আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে বিজ্ঞানকে প্রতিপক্ষ ও ক্ষতিকর বিদ্যা হিসেবে গণ্য করে। বৈজ্ঞানিক সত্য যখন ধর্মীয় লিখিত রূপের সাথে অমিল বা বিরোধ সৃষ্টি করছে, তখন স্বভাবতই তিনি ধর্মের অনুকূলে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন, আবার একটি সেতু নির্মাণের চেষ্টা করছেন ধর্মীয় টেক্সট থেকে বিজ্ঞানের টেক্সট অবধি। যে সেতুটির মাধ্যমে তিনি সহজে ধর্মবিশ্বাস ও বৈজ্ঞানিক সত্যের মাঝে সহজে যাতায়াত করতে পারবেন। “বিজ্ঞানময় কিতাব” ধরনের গ্রন্থ এবং অজস্য ওয়েবসাইটগুলো এই সেতুর প্রকৌশলী, রাজমিস্ত্রি, ও শ্রমিক। এগুলোরই উদয়াস্ত শ্রমে গড়ে ওঠে “নির্ভেজাল” ও “টেকসই” সেতুটি।

যারা এই সেতু নির্মাণ করেন, তারা দুটো বিষয় সবসময় খেয়াল রাখেন। এক. ধর্মগ্রন্থের বাণীর কাব্যময় ভাষা থেকে উৎপন্ন দ্ব্যর্থবোধকতা (ambiguity) এবং অনিশ্চিত অর্থ, এবং দুই. বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট ধারণার ব্যাপারে ভাসাভাসা জ্ঞান (popular knowledge)। এ যেন সেতুর সুদৃঢ় দুই থাম, দুই তীরের আছড়ে পড়া স্রোতকে বেঁধে রেখেছে। বিবর্তন তত্ত্বের ব্যাপারে এই বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সৃষ্টিবাদীরা (creationists) প্রধানত ইব্রাহিমীয় ধর্মগ্রন্থগুলোর কাব্যিক ও প্রাগৈতিহাসিক ভাষাকে আশ্রয় করে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে বিভিন্ন টুকরো বাক্য ও অনুচ্ছেদ তুলে আনে। কিন্তু অপ্রামাণ্য এসব বাক্য জীববিজ্ঞান কিংবা জিনবিজ্ঞানে মূল্যহীন। প্রাণিজগতের বিভিন্ন খুঁত ও গরমিল দেখিয়ে আমরা “নিখুঁত” বলে দাবি করা এই সৃষ্টিবাদকে ভুল প্রমাণ করতে পারি। তাই পরবর্তী ধাপে অচিরেই এর পাল্টা-জবাব হিসেবে সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তন মিলিয়ে একটি জগাখিচুড়ি বানানোর প্রক্রিয়া চলে। সৃষ্টির পর স্রষ্টার আদেশে/নির্দেশেই বিবর্তন নাকি চালু হয়েছে। একটি ঘরানা দাবি করছে প্রাণিকূলে একমাত্র মানুষ ব্যতিরেকে বাকি সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ বিবর্তন মেনে চলছে। মানুষকে স্রষ্টার আদলে গড়া হয়েছে বিধায় তা বিবর্তনের উর্ধ্বে। আদিমানুষ প্রজাতিগুলোর ফসিল সেই দাবিকে বাতিল করে দেয়। সেক্ষেত্রে আবার বলা হচ্ছে, মানুষেরও ক্রমবিবর্তন ঘটেছে, তবে তা কেবলই উন্নতির দিকে। এই দাবিকেও বানচাল করে দেয়া যায়। কিন্তু দেখা যায় এই দাবি উত্থাপনকারীদের বিবর্তনের ব্যাপারে উচ্চতর জ্ঞান নেই। তারা শুধুই ধর্মগ্রন্থ পড়েছেন, বিবর্তনের খুঁটিনাটি বিষয়-আশয় তারা তেমন বোঝেন না। ফলিত জিনবিদ্যার বিভিন্ন গবেষণাপত্র তাদের মাথার দুই মাইল উপরে উড়তে থাকে। অনেকে বিবর্তন বলতে বোঝেন “বানর থেকে মানুষ এসেছে এই থিওরি”, অনেকে এটা দাবি না করলেও মানুষের বিবর্তনের আধুনিক আবিষ্কারগুলোর ব্যাপারে কিছুই জানেন না। সুতরাং ধর্মগ্রন্থের দ্ব্যর্থবোধক বাক্য এবং বিজ্ঞানে দুর্বল ভিত্তি – এই দুইয়ে মিলে গড়ে তোলে গ্রন্থময়-বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানময়-গ্রন্থের ধ্যানধারণা।

দুই.

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই একগুঁয়ে সেতুটিকে ভাঙার উপায় কী? সেই উত্তর-সন্ধানের আগেও প্রশ্ন হলো, আদৌ কি ধর্ম ও বিজ্ঞানের এই সেতুবন্ধন ভাঙার দরকার আছে? বিজ্ঞানের শনৈ শনৈ উন্নতির কালের বয়স খুব বেশি নয়, মোটের ওপর পাঁচশ’ থেকে ছয়শ’ বছর। এই অল্প সময়েই ধর্মের মত প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের অচলায়তন ভেঙে পড়েছে। মানুষের সম্মিলিত জ্ঞানের সমষ্টিকে মানুষই সংরক্ষণ করছে, এবং সেই জ্ঞান সহসা বিলুপ্ত হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। বরং মননশীলতার সুযোগ ও স্বাধীনতা পেয়ে মানুষ ক্রমেই নিজের জ্ঞান বাড়িয়ে চলেছে। এই তো, গতকালই মানুষের বানানো নভোযান প্লুটোবাবুর উঠোন দিয়ে “হাই! হ্যালো!” বলতে বলতে উড়ে গেল। আধুনিকতম যুগের মানুষ ধর্মের প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করা কমিয়ে দিয়েছে অনেকাংশেই। রোগবালাই হলে আধুনিক মানুষ দোয়া পড়ার আগে ডাক্তারের কাছে যায়, রাস্তাঘাটে বেরুনোর আগে গন্তব্য দেখে নেয় গুগল ম্যাপে। আবার এটাও ঠিক যে পৃথিবীর অনেক অংশেই এই জ্ঞানের আলো পৌঁছায় নি। এখনো সেখানে অন্ধত্ব ও অন্ধকার বাস করে। এই বৈপরীত্যের দূরত্বও যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে অমন অন্ধকারেই ধর্মীয় অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি ঘাঁটি গেড়ে বসে। পাঁচশ’ বা এক হাজার বছর আগে যে অন্ধত্ব দূর করতে শিক্ষাদীক্ষার আলোই যথেষ্ট হতো, এখন সেখানে ভিন্ন উপায় প্রয়োজন হয়। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের জগদ্দল পাথরের প্রতিরোধক্ষমতা বেড়েছে। এই প্রতিষ্ঠানও আধুনিক হয়ে উঠেছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর বিজ্ঞান-মূর্খতার কারণে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে মিশিয়ে উপরে বর্ণিত একত্রীকরণ (amalgamation) ঘটেছে, সেতুতে সেতুতে ভরে উঠেছে মগজ। তাই আমার মতে, এই সেতুটিকে যুক্তির পথে ভেঙে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। সেতুটি ভেঙে পড়লে উপকার ব্যক্তিমানুষেরই। আমরা যদি তা বুঝতে ও বোঝাতে সক্ষম হই, তাহলে হয়তো “ডেমোলিশন” দ্রুত ও সহজ হবে।

এবারে আসি সেই প্রশ্নে, এই সেতু ভাঙার উপায় কী? বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি আর বৈচিত্র্যময় মানুষের মতনই বহুবিধ উপায় থাকতে পারে। আর সত্যি বলতে কী, আমার নিজের মাথাও চাচা চৌধরির মতো প্রখর নয়, যে মুস্কিল আসান এক তুড়িতেই বাতলাতে পারবো। তবুও কিছু কিছু ভাবনা মাথায় এসেছে, যেগুলো গ্রহণ-বর্জন প্রক্রিয়ার ভেতরে আছে। ধাপে ধাপে বলি।

প্রথমত, আমার মনে হয় ধৈর্য আর সময়ের পরীক্ষা এটি। ধৈর্যের সাথে কাউকে এই সেতুবন্ধনের খারাপ দিকটি বুঝাতে পারলে বাকি পথটুকু তিনি নিজেই খুঁজে বের করে নিতে পারবেন। দ্বিতীয়ত এটা খুবই পরিষ্কারভাবে বলতে হবে যে কারো ব্যক্তিগত অধিকারকে খর্ব করার কোন প্রচেষ্টাই এখানে হচ্ছে না। স্রষ্টা মানা ও ধর্ম পালনের অধিকার ব্যক্তির প্রাপ্য, এবং সেখানে অন্যের নাক বা হাত বা অন্য কোন অঙ্গ গলানোর এখতিয়ার নেই। তৃতীয়ত, কাউকে ধর্ম ত্যাগ করতেও বলা হচ্ছে না, বরং ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মাঝে গোঁজামিলের সেতুটি ভাঙতে বলা হচ্ছে। ধর্মপালনের সকল অধিকার যেমন তার আছে, তেমনি তার অধিকার আছে আধুনিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত হওয়ার। চতুর্থত (এবং সবচেয়ে কঠিন ধাপ), বিজ্ঞানের বক্তব্য যেখানে ধর্মগ্রন্থের সাথে সাংঘর্ষিক, সেখানে তাকে বোঝাতে হবে যে অনেক ধর্মের অনেক পুরানো নিয়মই বাতিল হয়ে গেছে। তার কারণ উন্নত সমাজব্যবস্থায় নতুন নিয়মের দরকার হয়েছে। এখন এই ২০১৫ সালে তিনি যে নিয়মকানুন মেনে চলেন, সেগুলো মূলত এখনো সমাজের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক না বলেই তিনি মানছেন। ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে ক্রমশ এসকল নিয়মও অচল হয়ে পড়বে এবং মানুষ উন্নততর সমাজ গড়ার নিমিত্তে নতুন নিয়ম বানিয়ে নিবে। কাকতালীয়ভাবে এটাও বিবর্তনের মতোই ধীর ও জটিল প্রক্রিয়া। তাই হাতে-নাতে প্রমাণ দেয়ার কিছু নেই। এখন তার কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি পুরাতন আংশিক-অচল নিয়মকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন, এবং ক্রমেই ধর্মগ্রন্থের দ্ব্যর্থবোধক বাক্যের সাথে বিজ্ঞানের সূত্রের ভাষা মেলাবেন? নাকি তিনি ধীরে ধীরে গ্রহণ করে নিবেন বৈজ্ঞানিক পন্থা আর যুক্তির শানিত অস্ত্র?

একজন রাজনঃ আই ওয়াজ কিয়োর্ড, অল রাইট!

গত বুধবার (জুলাই ৮, ২০১৫) সিলেট শহরতলীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শেখ সামিউল আলম রাজনকে খুঁটির সাথে বেঁধে ক্রমাগত পিটিয়ে হত্যা করে তিন যুবক। আর এই দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করে তাদেরই একজন। রাজনের বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামে। রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান পেশায় মাইক্রোবাসচালক। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে রাজন বড়। অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রাজন সবজি বিক্রি করত। সবজি বিক্রির টাকা দিয়েই চলতো রাজনের পরিবারের খরচ।

রাজনের লাশ গুমের সময় হাতেনাতে মুহিত আলম (২২) নামের একজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয় লোকজন। মুহিতসহ চারজনকে আসামি করে জালালাবাদ থানায় হত্যা মামলা করেছেন রাজনের বাবা। মামলার অন্য আসামিরা হলেন মুহিতের বড় ভাই সৌদি আরব প্রবাসী কামরুল ইসলাম (২৪), তাঁদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না (৪৫)।  চুরির অভিযোগ এনে গত বুধবার সিলেট শহরতলীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শিশু রাজনের ওপর নির্যাতন চালান কামরুল ইসলাম, আলী হায়দার ও ময়না। তাঁদের নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করেন মুহিত। তিনিই প্রথম ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেন।

[খবরের সূত্রঃ এখানে, সতর্কীকরণঃ খবরের ছবি ও ভিডিও মনের ওপর চাপ ফেলতে পারে। স্ক্রিনশটঃ এখানে, ছবি ও ভিডিও সরিয়ে রাখা হয়েছে।]

গতকাল থেকে শিশু নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টা মাথা থেকে বের করতে পারছি না। সেদিন সকালে বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা ছিল। ভোরবেলা উঠে দেখি বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকাকে চেপে ধরেছে, প্রথম ইনিংসে আফ্রিকা ৯৫/৫। হাত মুখ ধুয়ে আসতে আসতেই ১০০/৬। বেশ ভাল লাগছিল, স্ট্রিমিং দেখা শুরু করলাম। একটু পরেই ফেসবুকে দেখি এই ভয়ানক খবর। তারপর খেলায় জেতার পরেও গলায় কাঁটা আটকে থাকার অনুভূতি হচ্ছে। এক পর্যায়ে ফেসবুকই বন্ধ করে দিলাম। চারপাশের নানা মুনির মতামত আর ভাল লাগছিল না।

শিশুটিকে চোর অপবাদে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এরকম মারামারি আমাদের দেশে অহরহই ঘটে। প্রতিদিনই এরকম চোর বা পকেটমার ধরা পড়লে পাবলিক একত্র  হয়ে তাকে মার দেয়। কখনো কখনো পুলিশ এসে তাদের নিরস্ত করে, কখনো করেই না। শক্তপোক্ত  পোড় খাওয়া কেউ হলে মার খেয়ে টিকে যায়, কমবয়েসিরা মরে যায়। মারতে মারতে মেরে ফেলার পেছনে উন্মত্ত মবের মানসিকতাকে চিহ্নিত করেন কেউ কেউ। একজনকে ঘিরে যখন অনেকে মারতে শুরু করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই স্থিরভাবে চিন্তা করার অবস্থা লোপ পায়। সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে চোরকে যারা হাতে-নাতে ধরেছে, তেমন তিন থেকে পাঁচজন বেশি সক্রিয় থাকে। তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে আশেপাশের পাবলিক সক্রিয় হয়ে ওঠে। সহিংসতা ক্রমশ সংক্রামিত হয়। এই মবের ভেতর হয়তো দুয়েকজন সহিংসতায় আক্রান্ত হয় না, কিন্তু তারাও নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়েই থাকেন। খুব কম পরিস্থিতিতেই সহিংসদের নিরস্ত করা যায়।

ফেসবুকে এই ভিডিও ছড়িয়ে যাওয়ার পরে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা আমাকে বিস্মিত করে। এরকম ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহই ঘটে, আমরা অনেকেই এইসব ঘটনা বাস্তবে এড়িয়ে যাই। কোনখানে মানুষ একত্র হয়ে কাউকে মারছে দেখলে খুব কম মানুষই এগিয়ে গিয়ে সেটা থামাতে যায়। বেশিরভাগ দাঁড়িয়ে “মজা দেখে”, অনেকে নিজ নিজ কাজে চলে যায়। এই ঘটনা ইদানিং বেশি ঘটছে এমনও না, আগেও ছিল, এখনও আছে। ঘটনাগুলো এতোটাই “স্বাভাবিক” যে সবগুলো খবরের কাগজেও আসে না। যেসব ক্ষেত্রে ভিক্টিমকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, সেগুলোই সাধারণত খবর হয়ে ওঠে। গুগলে “চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা” লিখে সার্চ করলে প্রায় ৭৯,৮০০ ফলাফল পাওয়া যায়। এই সংখ্যাটি ভীতিকর। এই সংখ্যাটি প্রমাণ করে যে আমরা সমষ্টিগতভাবে ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়ে থাকি।

তাহলে রাজনের হত্যার ঘটনায় এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া কেন হচ্ছে? সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। বাংলাদেশের সামাজিক মনস্তত্ত্ব বিষয়ে আমি অজ্ঞ। কেবল নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ উত্তরটিই চিন্তা করে দাঁড় করাতে পারি, তবে তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত উত্তর।

আমার মতে, রাজনের ঘটনায় এমন প্রতিক্রিয়ার পেছনে কতগুলো বিশেষ কারণ রয়েছে। প্রথমত, এই ঘটনাটি first person point of view থেকে ভিডিও করা হয়েছে। রাজনকে ধরে একটা থামের সাথে বেঁধে রাখা থেকে ভিডিওটি শুরু হয়। আমি ১১-১২ মিনিটের ভিডিওটি দেখেছি, যেখানে ধীরে ধীরে মার খেতে খেতে রাজনের মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে যেতে থাকে। শুরুতে সে যেভাবে ক্ষমা চাচ্ছিল আর মার দেয়ার সাথে সাথে ব্যথা পেয়ে কেঁদে উঠছিল, সেটা ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। রাজন ক্লান্ত হয়ে পড়তে থাকে। ধারণা করি, তার ব্যথাবোধের অনুভূতিও ভোঁতা হতে শুরু করেছিল। ভিডিও ধারণ করেছিল হত্যাকারীদেরই একজন, এবং আমরা ক্যামেরার পেছনে তার কথা ও হাসিও শুনতে পাই। এর চেয়ে সরাসরি চোখের সামনে একজন মানুষকে ধীরে ধীরে মরে যেতে দেখা সম্ভব না। বেশ কিছুদিন ধরে মধ্য প্রাচ্যের আইসিস “ইনফিডেল”দের হত্যা করার সরাসরি ভিডিও প্রকাশ করছে। সেগুলো দেখলে প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের বিবমিষা হতে বাধ্য। দর্শক সেখানে আইসিসের হত্যাকাণ্ডের স্থানে সরাসরি প্রবেশ করে, এবং হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে। ভিডিও বন্ধ করে না দেয়া পর্যন্ত নিজের অনিচ্ছাতেই দর্শককে এই নারকীয় ঘটনাগুলোর অংশ হতে হয়। রাজনের হত্যার ভিডিও দেখে দর্শকের মনে তাই তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক।

দ্বিতীয়ত, আমার মনে হয় ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে যাওয়ায় এই প্রতিক্রিয়ায় আরেকটি ভিন্ন মাত্রা, ভিন্ন তীব্রতা যোগ হয়েছে। ফেসবুকে বাংলাদেশি ইউজারের সংখ্যা কত জানার চেষ্টা করছিলাম। ফেসবুক জানাচ্ছে এই মুহূর্তে ১৩ থেকে ৬৫ বছর বয়সী প্রায় এক কোটি ৩০ লক্ষ বাংলাদেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন। অডিয়েন্স হিসেবে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিডিওটি যে কোন সময়েই এক ক্লিকে দেখতে পারবেন। এছাড়াও ভিডিওটি ইউটিউবে আছে, গুগল করলে শ’খানেক নিউজ-পোর্টালে আছে, এবং এটা বিভিন্ন ইমেইল সার্ভার দিয়েও ছড়িয়েছে। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির উন্নতির কারণে আক্ষরিক অর্থেই ইন্টারনেট এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। এমন অবাধ তথ্যের স্বাধীনতা যেমন উপকারী, তেমনি দানবীয় শক্তিও বটে। রাজনের মৃত্যুর ভিডিও তাই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটকে অনেকেই স্রেফ বিনোদনের জন্য ব্যবহার করেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে ফেসবুক দেশের সাথে সরাসরি যোগসূত্রের মাধ্যম। এরকম মাধ্যমে যখন রাজনের মৃত্যুর ভিডিও এসে পড়ে, তখন আমরা সরাসরি বাস্তবের এক ভয়াবহ ধাক্কা খাই। এটা তখন আর স্রেফ বিনোদন আর চটুল রসিকতার জায়গা থাকে না। চ্যানেল পাল্টে দিলেই যে খবরকে এড়িয়ে যাওয়া যেতো, কিংবা পত্রিকার পাতা উল্টে যে খবরকে না পড়েও দিন শুরু করা যেতো, সে খবর এখন এড়ানোর আর উপায় নেই।

“এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ” মুভির অ্যালেক্সকে চোখের পাতা জোরপূর্বক খুলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাতজি জার্মানির ধ্বংসযজ্ঞ দেখানো হয় (দৃশ্যটি এখানে)। অ্যালেক্সের অপরাধের শাস্তি বা সংশোধনের ধাপ হিসেবে তাকে এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। রাজনের হত্যার ভিডিও দেখে ফেসবুকে তীব্র চিৎকার করে ওঠা আপামর বাংলাদেশিদের দেখে কেন জানি এই দৃশ্যের কথাই বারবার মনে পড়ছিল। এমন তো নয় যে আমরা এমন অপরাধ স্বচক্ষে এই প্রথম দেখছি, কিংবা এর চেয়ে ভয়ানক অপরাধ আর আগে ঘটে নি। বরং এই হত্যাকাণ্ড আমাদের প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির অংশই বটে। আমরা এর চাইতেও ভয়ানক অপরাধের সাক্ষী। কিন্তু এবারের ঘটনার বিশেষত্ব হলো, এটি ঘটছে আমাদের বিনোদন ও স্বস্তির এলাকায়, আমাদের ফেসবুকিং ও meme-জীবনে, আমাদের কমেডি ও স্যাটায়ারের বর্ণিল বাবল্‌-এ রাজনের আর্তচিৎকার ঢুকে পড়েছে। ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জের অ্যালেক্স নিজে পিটিয়ে খুন করেছে, তার কাছে তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসের ফিল্ম বেশি কিছু লাগার কথা না। কিন্তু সে চিৎকার করে ওঠে কারণ যুদ্ধের ফিল্মের পটভূমিতে বিইটোভেনের নবম সিম্ফোনির সুর আবহ সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা শুনে সঙ্গীতপিপাসু অ্যালেক্সের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। বিইটোভেন তার কাছে স্বর্গীর সুরস্রষ্টা, আনন্দ ও স্বস্তির জায়গা। তাই তাকে যখন সহিংসতার পটভূমিতে ব্যবহার করা হয়, তখন সেটা অ্যালেক্সের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমাদের জন্যেও ফেসবুকের বিনোদনের সাথে রাজনের ভিডিওর উপস্থিতি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলেই এতটা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখছি।

রাজনের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিক্রিয়ার তৃতীয় ও সবচেয়ে বেদনাদায়ক কারণটি হলো, আমাদের সম্মিলিত মননে ও চিন্তায় আমরা নিশ্চিত না যে এই অপরাধের বিচার হবে এবং এই নারকীয় মারধরের সংস্কৃতি নির্মূল হবে। আমরা জানি যে রাজনের হত্যাকাণ্ডের মূল অপরাধীদের একজন কামরুল ইসলাম শুক্রবারেই (১০ জুলাই) দ্রুত সৌদি আরব পালিয়ে গিয়েছিল। ছয় লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে সিলেটের পুলিশই তাকে সাহায্য করেছে পালিয়ে যেতে। সামাজিক মাধ্যম থেকে খবর মাধ্যমে এই হত্যার প্রতিবাদ তীব্র হলে সৌদি পুলিশের সাহায্য নিয়ে সোমবারে কামরুলকে আটক করা হয়েছে। আদালতের দীর্ঘসূত্রিতায় এই অপরাধের শাস্তি হতে কতদিন লাগবে তা আমরা জানি না। আমরা এটাও জানি না যে আদৌ তাদের অপরাধ প্রমাণিত হবে এবং যথাযথ শাস্তি হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অপরাধী ক্ষমতাবান ও অর্থশালী হলে প্রায় কখনই তার শাস্তি হয় না। যে সকল ঘটনায় আমরা শাস্তি হতে দেখছি, সেখানে জনগণ ও মিডিয়ার সক্রিয়তা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আমাদের সম্মিলিত আগ্রহ কমে এলে বিচারপ্রক্রিয়াও একপ্রকার থেমে যায়। তারপরও আশাবাদী হয়ে ধরে নিচ্ছি যে ফেসবুকের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে আমরা এই অপরাধের বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে দেখবো। রাজনের বাবা-মা ন্যায়বিচার পাবেন। অপরাধীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু তারপরেও কি আমরা নিশ্চিত যে রাজনের মতো আর কেউ গণপিটুনিতে মারা যাবে না? এই নিত্যনৈমিত্তিক মারপিটের ঘটনা ঘটতেই থাকবে, পাশবিক মব যা আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষিত বাংলাদেশিদের দিয়ে গড়া, তারা তীব্র রোষে অন্য কোন চোর বা পকেটমারকে মেরে খুন করে ফেলবে। এই নৃশংস সংস্কৃতি আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এই অভাবিত ও নিষ্ঠুর সত্যের সামনে রাজনের নিষ্প্রাণ মুখ আমাদের আজ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বলে আমরা আর আয়নার সামনে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না।

বন্যা আপা

ফেসবুকের একটা সাম্প্রতিক ফিচার হলো ‘save this link/video’ সুবিধা দেয়া। কেউ কোন কিছু শেয়ার করলে সেটাকে পরে পড়া বা দেখার জন্য রেখে দেয়া যায়। গত সপ্তাহখানেক ধরে অনেক ব্যস্ত ছিলাম। শান্তি মতো কোন কিছু পড়ার মন ছিল না। তাই আজকে ছুটির দিনে সেসব লিংক পড়তে বসলাম। রায়হান অনেকগুলো পোস্ট দিয়েছে, বন্যা আপার ভলতেয়ার বক্তৃতা নিয়ে। সেগুলো দেখলাম। বিবিসি বন্যা আপার একটা ইন্টারভিউ প্রকাশ করেছে আজকেই। ইন্টারভিউটা দেখে কেন যেন মনে হচ্ছিল ইন্টারভিউ গ্রহণকারী খুবই বেসিক প্রশ্ন করছিলেন। সম্ভবত তাদের চ্যানেলের দর্শকরা এই পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তি ধারণ করেন। তারা বেশিরভাগই ধার্মিক এবং ধর্মভীরু। তারা অনেকেই হয়তো ভাবতেই পারেন না একজন নাস্তিক কেমন হয়। নাস্তিকরা আসলে কেন নাস্তিক, কিংবা তারাও আসলে কোন ভুলভাল করছেন কি না, সেটা তাদের কাছে একটা প্রশ্ন। বন্যা আপা যখন বললেন যে তিনি ১৩ বছর বয়স থেকেই অবিশ্বাসী, সেটা শুনে ইন্টারভিউ গ্রহণকারীকে বিস্মিতই মনে হলো। ইন্টারভিউয়ের পরে স্টুডিওতে কয়েকজন মিলে আলোচনাও করলো। এসবক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, দুই মতধারার কয়েকজনকে এনে একটা তর্কের পরিস্থিতি গড়ে তোলা হয়। একদিকে দুয়েকজন ফ্রিডম অফ স্পিচ নিয়ে কথা বললো, আরেকদিকে দুইজন বিশ্বাসী অভিযোগ করলো যে তারা নাস্তিকের কথায় অফেন্ডেড হয়, তাই নাস্তিকদের বুঝেশুনে কথা বলা উচিত। অতঃপর এসব আলোচনার শেষে মিলেমিশে গেল তারা দুই দলই। দেখে একটা পাদ ছাড়লাম।

নিক কোহেন বন্যা আপার ভলতেয়ারের বক্তৃতা নিয়ে একটা ব্লগ লিখেছেন। সে বক্তৃতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সেখানে উঠে এসেছে বাংলাদেশে ইসলামিস্ট রাজনীতি এবং তুলনায় এসেছে ইংল্যান্ডের ইসলামিস্ট রাজনীতির পরিস্থিতি। রায়হানকে ধন্যবাদ লেখাটাকে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য। পুরো বিষয়টা এর চেয়ে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যেতো না। আগ্রহীরা লিংকগুলোতে ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি সম্পূর্ণভাবেই আশাহত হয়ে পড়েছি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের নিয়ে। যেদিকে তাকাই অস্ফূট দুয়েকটি ঝিলিক দেয়া আলো ছাড়া বাকিটা মিশমিশে অন্ধকার দেখি। একটি পশ্চাদপসর জাতিতে আমার জন্ম। এই জাতি পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞান সভ্যতায় শিক্ষায় কোন অবদানই রাখে নি। আজও সামাজিক কুসংস্কারের আখড়া বানিয়ে মানুষের জীবনকে পিষে মারা হয় বাংলাদেশে। এখানে খুব কম মানুষই স্বপ্ন দেখে, তাদেরও অনেকেই ঝরে যায় স্বপ্নকে সফল করার আগে। এই জাতির খুব কম মানুষই সাহসী। সাহসকে এখানে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। কেউ ভুল করেও কোন সাহসী কাজ করে ফেললে আমরা সাধারণত তাকে দেখে ভয় পেয়ে যাই। আমরা ভয় পাই কারণ এই সাহস এক অচেনা চরিত্র আমাদের কাছে, আর অচেনাকে ভয় পাওয়াই মানুষের ধর্ম। সাহসের কারণে সেই মানুষটি অতি দ্রুত টার্গেটে পরিণত হন। অনেকেই নিন্দা ও সমালোচনা করে তার থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করে নেন। এতে তাদের একটা লাভ হয়। কিছুদিন পরে যখন ঘাতকরা সাহসী মানুষটিকে খুন করতে আসে, তখন নিন্দা ও সমালোচনাকারীরা নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারেন। তেলাপোকার জীবনও এত অর্থহীন না!

সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো এই জাতির অজ্ঞানতার তালগাছ আঁকড়ে ধরার চরিত্রটি। কালেভদ্রে কোন কালজয়ী মানুষ যখন এই জাতিকে পথ দেখায়, তখন গোঁয়ার-গোবিন্দের মতো নিজেদের গোঁড়ামি আর অন্ধত্বকেই প্রাণপনে চেপে ধরে এরা। এই ঘটনাটি বারবার ঘটেছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে সামাজিক নেতা পর্যন্ত, লেখক থেকে শিক্ষক পর্যন্ত অনেকেই সুউচ্চ আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। এবং ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগও এই জাতিকে তালগাছের মায়া ছাড়াতে পারে নি।

গতকাল সুপারম্যান ভার্সাস ব্যাটম্যান মুভির ট্রেলার রিলিজ পেয়েছে। সেখানে ব্রুস ওয়েইনের একটা সংলাপ এরকম, “বিশ বছর পরে আর গথামে কয়জন ভালো মানুষ বেঁচে আছে? যারা আছে তারা কয়জনই বা আর ভাল আছে?”

বাংলাদেশকে বরাবরই আমার গথামের মত নষ্টভ্রষ্টপতিত শহরের মতো মনে হয়। ব্রুস ওয়েইনের এই কথাটা হয়তো তাই আমাদের জন্যই বেশি খাটে। আমাদের ভালো মানুষদের মেরে ফেলা হয়। আর যারা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকেন, তারাও টিকে থাকার প্রয়োজনে নিজেদেরকে বদলে ফেলেন!

হৃৎপ্রাচীর

মাঝে মাঝে এমন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ দিন আসে। ভোরের আলোর মোলায়েম পরশ থাকে না। স্লেটের মতো ছাইমাখা আকাশ ভয়ঙ্কর থমথমে চোখে চেয়ে থাকে। তার নিচেই ধাতব শীতল বাতাস এলোমেলো ঘুরতে থাকে। এমন দিনে রাস্তায় বেরুলে কোন মানুষ দেখবে না, দেখবে সারি সারি মৃত মুখ, নিস্প্রভ আলোহীন অবয়বে হেঁটে যাচ্ছে। সূর্যহীন আকাশের কারণে অবয়বগুলোর কোন ছায়া পড়ে না মাটিতে। তারা যেন মসৃণ কালো রাস্তার পাশ দিয়ে কিছুটা পিছলে পিছলে চলে যেতে থাকে। তোমাকে ছাড়িয়ে উঁচু উঁচু দালানগুলোও সেদিন ভেঙে চুরে আসে। তোমার মাথার ‘পরে দুমড়ে মুচড়ে পড়তে থাকে। তুমি দালানের সীমানা পেরিয়ে গেলে তারা আবার ঐ উঁচুতেই ফিরে যায়। তুমি পেছন ফিরে তাকালে দেখো স্লেটরঙা আকাশের জমিনে কালো খড়ের মতো সারি সারি দালান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তোমাকে দেখতে পেয়ে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে থাকে। তাদের ধাতব শীতল শরীরে হরেক রঙের জানালা-চোখ তোমাকে দেখে ক্রূর ঠাট্টার স্বরে কথা বলে ওঠে। এমন দিনে রাস্তায় কোন সুন্দরীকে দেখে তোমার থমকে দাঁড়াতে ইচ্ছা হবে। তুমি ভাববে এক মুহূর্তের অবসর পেলে তার চোখের দিকে তাকাবো। ভাববে এলোবাতাসে তার পিঙ্গল চুল উড়ে বেড়ালে তুমি সেই সুবাস নিবে। হয়তো অনুমান করার চেষ্টা করবে মেয়েটি কোন শ্যাম্পু ব্যবহার করেছে। গারনিয়ের ফ্রুকটিস? প্যানটিন প্রো-ভি? নাকি তার চুল শক্ত করে বেণী করা। বাতাসে সেই চুল উড়বে না। তুমি তার সুবাসও পাবে না। তারপর তুমি ভাববে, মেয়েটির চেহারা এক ঝলক দেখতে পারলে মন্দ হতো না। একটু এগিয়ে তার মুখের দিকে তাকালে দেখবে চাঁদের ক্ষতের মতো পোড়া পোড়া গর্ত। সে গর্তের ভেতর দিয়ে তুমি দেখবে তার খুলির ভেতরে কিলবিল করছে হলদে হলদে ম্যাগট। তার মুখ গহ্বর থেকে আমিষের আঁষটে গন্ধ এসে ধাক্কা দেবে তোমার নাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তুমি বুঝবে মেয়েটি মারা গেছে কয়েকশ বছর আগেই। তার জীবন্মৃত দেহ গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে। তার ভেতরে কোন স্বপ্ন নেই, সুখ নেই, হতাশা নেই, কামনা নেই। তোমার বুক ভেঙে যাবে। মনে হবে তাকে আলতো করে তুলে নিই। কোমল আদরে দু’হাতে ধরে শুইয়ে দিই কোন সবুজ বৃক্ষের তলে। চিরহরিৎ গুল্মের পরতে ঢেকে দেই তার বিশুষ্ক দেহ। বৃক্ষের শেকড়ে জড়িয়ে মিশে যাক তার পিঙ্গল চুল। তারপর তোমার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু নামুক বৃষ্টি হয়ে। কিন্তু তোমার এই সাধ পূর্ণ হবে না। ভেবেচিন্তে কিছু করার আগেই মেয়েটি আরো অজস্র মেয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাবে। নানারকম নানারঙের মেয়েদের দঙ্গল দেখবে দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের পাশে পাশে দেখবে আরো অজস্র পুরুষ ছিন্নভিন্ন কঙ্কাল আঁকড়ে ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর এদের সকলের ওপরে স্লেটের মতো আকাশ। ঝঞ্ঝার মতো মেঘ। ধাতব সীসার মতো বাতাস। সূর্যহীন অবিশ্রান্ত দিন।

আর ঘরের দরজা খুলে আয়নায় নিজের ক্লান্ত মুখ দেখবে চাইবে। কিন্তু তুমি ঘর খুঁজে পাবে না। ঠিকানাটা ঠিকঠাক মনে থাকলেও সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখবে ঘর নেই। সেখানে কৃষ্ণগহ্বরের শূন্যতা। নিজের ক্লান্ত মুখ তোমার আর দেখা হবে না। দু’হাতের আঙুলে হাতড়ে হাতড়ে মুখে বুলিয়ে বুঝতে চাইবে কতোটা নোনাজলের দাগ, পলিমাটির ধুলো সেই মুখে লেগে আছে।

আর তোমার খুব ঘুমাতে ইচ্ছা করবে। কিন্তু ঠিক তখনই হাতের আঙুলে ছুঁয়ে দেখতে পাবে তোমার অক্ষিকোটর শূন্য। সেখানে স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন নেই, সুখ নেই, হতাশা নেই, কামনা নেই। ঘুম নেই।

এলোমেলো …

বনানী থেকে ফার্মগেইট হয়ে কাঁটাবনে মাত্র বিশ মিনিটে পৌঁছে গেলে সন্দেহ হয়ঃ ঘড়ি বিকল হয়েছে, অথবা এ শহরে মৃতদের বসবাস। অযুত মাল্টিভার্সের কোনো একটায় হয়তো এটা সম্ভব হতেও পারে। কিন্তু আমি যে শহরে থাকি, সেখানে পথেই আনন্দ!

টুকরো জিনিসগুলোর জন্যে মায়া হয়। অনেক বছর ধরে ওরা আমার সাথে আছে। দিনে দিনে ক্ষয়ে গেছে, সময় খুবলে খুবলে নিয়ে গেছে শরীর-মহার্ঘ্য। আমি কেবল খোলনলচে আগলে রেখেছি – পুরাতন স্মৃতির মতো। টুকরো জিনিসগুলোর ফিডেলিটির কোনো দাম দেয় না কেউ।

চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। কোন্‌ কালে পৃথিবীর উদর থেকে ছিটকে গিয়ে জন্মেছে, নাড়ী কেটেছে ভ্যাকুয়াম। তারপরে মায়ের নাড়ীর টানে ঘুরছে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে পড়ে, তবে মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না।

মানুষ স্বভাবতই স্ক্র্যুড-আপ। আমি, তুমি, সে, তারা, আমরা, ও, ওরা, তারা, উনি, আপনি, উনারা, আপনারা। সব সর্বনাম বিশিষ্টজন নামসর্বস্ব হলেও, তারা সবাই মূলত স্ক্র্যুড-আপ। আমরা খালি ভড়ঙ আর ভান ধরি, মুখোশ পরি, পরিহাস্যের যাপনকাল।

সেদিন কম্পুখানা মারা গেলো। পাঁচশো গিগাবাইটের স্মৃতি মুছে গেলো এক মুহূর্তেই। জমে থাকা কথাগুলো, চিঠিগুলো, ছবি ও তোমার হাতে ধরে তিরতিরে প্রদীপ – মুছে গেলো। হারিয়ে গেলো খুনসুটির বছর, কান্নার দুইশ বিনিদ্র রাত। তার সাথে চলে গেলো জমিয়ে তোলা সবকিছুই।

সুঁইয়ের ছ্যাদায় সুতো ভরার মতো জীবনের এক ফুটো দিয়ে সব ঘটনা-রটনা পুরে দেয়ার চেষ্টা করছি। ঘটনাগুলোর বেখাপ্পা গড়নের কারণে বারবার হড়কে যাচ্ছে, ঠিকঠাক ঢুকছে না। মাঝে মাঝে করুণ রস জিবে করে ওগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছি, নরম করে দিচ্ছি। তারপর ক্রুদ্ধ উৎকণ্ঠা, এবারে নিশ্চয়ই জীবন গুছিয়ে যাবে, মৃত্যুর আগেই জিতে যাবো শ্বাসরুদ্ধ।

এভাবে হয় না জেনেও ছেলেটা চেষ্টা করছে। চারপাশে অনেকে হা হা হা হা করে হাসছে তার ব্যর্থতায়। কিন্তু তারা খেয়াল করছে না এই সব ব্যর্থতা এক বিশালকায় স্তুপ তৈরি করে ফেলছে। দূর থেকে দেখলে সেটা পাহাড় বলে বিভ্রম হয়।

বোদলেয়ার ও মানিকের সাথে টুকরো আলাপ…

যতো প্রযুক্তিই আসুক আর বাংলাদেশে বাস করে যতোই ডিজিটাল হয়ে উঠি না কেন, সেই ছাপার অক্ষরের বইয়ের কাছে ফিরতেই হয়। সেদিন খোলামকুচির মতো বিনা পয়সায় পাওয়া এক বিকালে বেশ মোটা আর গরম মানিব্যাগ নিয়ে বইয়ের দোকানে ঢুকেছি। যে নেশায় ডিভিডি কিনি, তার চেয়েও অবাধে বই কিনতে ইচ্ছা হলো। দুই হাতে বইলে টনটন করে য়্যাতো গাদা বই কিনে আনলাম।

তাদের সাথে উল্টেপাল্টে কথা হয়। এক টানা কোনোটাই বেশি সময় পড়তে পারি না, অন্যজন বেশ লাস্যময়ী ‘লুক’ দেয়, ‘হিন্ট’ দেয়। তাই বই থেকে বইয়ে ভাসি। ছাপার অক্ষরগুলো বালিশের সাথে লেপ্টে যায়, আমার সাথেই রাত ফুরোলে ঘুমায়।

Charle Baudelaire

বোদলেয়ারের “ক্লেদজ কুসুম” পড়েছিলাম যৌবনের শুরুতে, টগবগে রক্তে আগুন আর মদ ঢুকে গিয়েছিলো কবিতার ছদ্মবেশে। আর এতোদিন পরে হাতে পড়লো “প্যারিস স্‌প্লীন“। বিষণ্ণ কবির মুক্তগদ্য, তথা গদ্য কবিতা। উপমা আর দৃশ্যকল্পে ঠাসা, ছাড়া ছাড়া বুনোটের বাক্য দিয়ে এক একটা লেখা। অনুবাদ পশ্চিম বঙ্গীয়, এবং বঙ্গদেশের বাজে অনুবাদের গৌরব বজায় রেখে এক্কেবারে যাচ্ছে তাই। পড়তে পড়তে ফরাসি ভাষা না জানার আফসোস কামড়ে কামড়ে ধরলো, শেষে ইংরেজি অনুবাদগুলো পড়লাম। বাংলা অনুবাদকারীকে শাপশাপান্ত করতে করতে অগত্যা রস খেলাম অন্যের হাতে, ভিন ভাষায়! তবে বোদলেয়ার-পাঠের আনন্দে এই ভাষা-পথের দূরত্বটাকে পাত্তা দিলাম না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

বোদলেয়্যারের সাথে বাতচিতে মজে আছি, এমন সময় ওপাশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পর্দার আড়াল থেকে ডাক দিলেন। “অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়” বইটা কিনেছি। ডায়েরি – চিঠির যে জঞ্জাল মানিক ফেলে রেখে গেছেন, তার মাঝে নাক ডুবিয়ে দিলাম। বিয়িং জন ম্যালকোভিচের মতো মনে হলো নিজেকে। ডায়েরি পড়তে পড়তে হোঁচট খেতে হয়, দিন পরম্পরা নেই, বিষয় পরম্পরা নেই, গল্পের প্লটের পরেই বাজারের ফর্দ, তার পরেই ডাক্তারের কাছ থেকে ‘কিনতে হবে’ ওষুধের লিস্টি, পরের পাতাতেই তিন বছর পরের ঘটনা লিখে রাখা (সেদিন বোধহয় ধর্মঘট হয়েছিলো)! মানিকের লেখার সাথে পরিচয় প্রায় দশ বছর, কিন্তু এখন যেন আরেক মানুষকে চিনলাম। রক্তমাংসে গড়া, জ্বল জ্বল করছেন, কষ্ট পাচ্ছেন, রোগে ভুগছেন, খকখক করে কাশছেন, ধুতির খুটে চশমা মুছছেন। আবার এসবের মধ্যেই দুর্দান্ত কোনো গল্পের প্লট লিখে রাখছেন তিন চার বাক্যে!! সুপারম্যান-ক্লার্ক কেন্ট, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ!!

বোদলেয়ার ততোক্ষণে রুষ্ট কিছুটা। ডেকে নিয়ে এক চোট বকলেন। তারপরে নিচের লেখাটা পড়লাম। থমকে গেলাম মানুষের বর্ণনায় – – – –

Le Chien Et Le Flacon
“— আমার সুন্দর সারমেয়, আমার কোমল কুকুর, আমার প্রিয় কুতুয়া, এগিয়ে এসে শোঁকো তো, শহরের শ্রেষ্ঠ আতরও’লার কাছ থেকে কেনা এই অপূর্ব আতর!”

কুকুরটা খুব লেজ নাচিয়ে এগিয়ে এলো, মনে হয় আদতে এটা এই অবলা প্রাণীদের স্মিত হাসি আর বক্রোষ্ঠীর প্রকাশ, কৌতূহলভরে এগিয়ে এসে ওর ভেজা নাকটা ডুবিয়ে দিল আতরদানির খোলা মুখে, তারপর হঠাৎই ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়ে আমার দিকে চেয়ে ঘেউঘেউ করে উঠলো, যেনো নিন্দা করছে।

“— ওরে ও হতভাগা কুত্তা! তোকে যদি আমি একদলা বিষ্ঠা দিতাম তবে তো তুই মহানন্দে শুঁকতি, হয়তো গিলেও নিতি, তুই এমনই আমার বিষণ্ণ জীবনের অযোগ্য সঙ্গী। তুই ঠিক ভিড়ের মানুষগুলোর মতোন, যাদের কোন সুগন্ধি দিতে নেই, তাতে ওরা অতিষ্ঠ হয়, ওদের দিতে হয় বাছাই করা গু।”

মূল লেখা

আমি নিজেও ভিড়ের মানুষ। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কুকুরের মতো আমরা একে অপরের বগলে-ঘাড়ে ঘামের গন্ধ নিই। ওটাই আমাদের সয়। ফরাসি সৌরভে নাক জ্বালাপোড়া করে।

বোদলেয়ারের কথা শুনে মানিকও তার চশমা ঠিক ঠাক করে গলা খাকারি দিলেন। হাট করে খুলে গেলো নববর্ষের পাতা, ১৯৪৯ সালের, আজ থেকে ৬১ বছর আগের পহেলা জানুয়ারি…

১ জানুয়ারি, ১৯৪৯, শনিবার

এবারও কি সুরুতেই শেষ হবে? দেখা যাক। ডায়েরি রাখতে পারি না কেন? বোধ হয় এই ধারণা থেকে গেছে বলে যে ডায়েরি মানেই নিছক ব্যক্তিগত কথা! কয়েকদিন লেখার পর আর উৎসাহ পাই না।

ট্রামের প্রথম শ্রেণীর ভাড়া এক পয়সা বাড়লো! যাত্রীরা চটেছে মনে হলো না। বেশ খানিকটা হাল্‌কা ভাবেই বৃদ্ধিটা গ্রহণ করেছে। বরং যাত্রীদের এই উদাসীন ভাবে কণ্ডাক্টররা ক্ষুব্ধ — অশ্রদ্ধার সুরে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য শুনলাম দু’একটা, ভাবটা এইঃ কিছু হবে না এদের দ্বারা! মর তোমরা — আমাদের কি! ট্রাম ধর্মঘট ফেঁসে যাবার পর যাত্রীদের এভাবে ভাড়া বৃদ্ধি মেনে নেয়ার ফলে সংগ্রামী ট্রাম কর্মীদের এইরকম মনোভাবই স্বাভাবিক।

আসলে, বাবু যাত্রীদের তলিয়ে হিসার করা নেই — একবার টিকিট কাটতে মোটে এক পয়সা — আজকাল একটা পয়সা সামান্য! এই এক একটা পয়সা থেকে কোম্পানী যে গলা কেটে কতো মোটা লাভ করবে সেটা খেয়ালে আসে না। মনে পড়লেও গ্রাহ্য নেই — ভদ্রলোক তো — নিজের কথাই বড়োঃ আমাকে তো মোটে একটা করে পয়সা দিতে হচ্ছে — মরুক গে যাক! নীতিটা বড়ো নয় — অন্যায় করে একটা পয়সা কেউ আদায় করলে সেটা সহ্য করাও যে কতো বড়ো অন্যায় সে ধারণা নেই। ট্রামে ভীষণ ভীড়!

—০—

মানিক ঠিক ধরেছেন। ধ্বজভঙ্গ মধ্যবিত্তের নীতিবোধ দিনে দিনে আরো সুচারু এবং চালাক হয়ে গেছে। এখন আমরা নীতি নামক বস্তুটিকে জাদুঘরে তুলে রেখে দিয়েছি। ওটাতে তেল দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়, মাঝে মাঝে সপ্তা-এন্ডে জাদুঘরে ঘুরতে গেলে ওটা শিশুদের দেখিয়ে বিস্মিত করে দিই আমরা বয়োজ্যেষ্ঠ মধ্যবিত্তেরা।


মানুষে মানুষে মিল বা অমিল নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও চিন্তা বরাবরই ভিন্ন। সেরকম একটা গল্পের প্লট লিখে রেখেছেন, সময়াভাবে হয়তো লিখে শেষ করেন নি, বা করতে পারেন নি। প্লটঃ

গল্পের প্লটঃ বিশ্বাসী নির্ব্বিকার পূজারী — কিছুতেই বিচলিত নন — সন্তানের মৃত্যুতেও নয় — ঈশ্বর অবিশ্বাসী অন্যজন ধর্ম্মের কোন ব্যাপারে বিচলিত নয় — বিগ্রহ চুরি যাওয়ায় প্রথম জনের শোক — সন্তানের মরণে দ্বিতীয় জনের শোক — দুজনের শোক একরকম —

—০—

ডটডটঃ ভাবছি, বোদলেয়ার আর মানিক এই যুগে ব্লগ লিখলে কেমন বেসামাল অবস্থা হইতো?! ভাবতাছি

নগরাত্মিক

মি যে শহরে বাস করি, সেখানে ফুটপাতে প্রায়ই পাগল পাওয়া যায়। আপনি যদি ভাবেন এটা উল্লেখযোগ্য কোন বিষয়ই নয়, তবে আপনি ভুল করবেন। পৃথিবীর আর কোথাও এমন বৈচিত্র্যময়, উদ্ভিন্ন পাগল আপনি ফুটপাতে ফুটপাতে বিজ্ঞাপিত হতে দেখবেন না। পৃথিবীর পথেঘাটে এভাবে তাদেরকে ছেড়ে রাখা হয় না। তারা মানব প্রজাতির অমূল্য সম্পদ, তাই তাদেরকে কড়া রক্ষণাবেক্ষণে রাখা হয়। প্রজাতিটির বর্তমান চালু নমুনাগুলো চায় না তাদের এই উন্নত জেনেটিক্স থেকে আরেকটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হোক। তাই তারা জননরোধী হয়ে উঠেছে, পাগলের মস্তিষ্কের জিন যেত প্রবাহিত হতে না পারে সকল পাগল-জরায়ু এবং অপাগল-জরায়ুতে, এজন্য তারা পাগলদের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।

সে যাক গে, যা বলছিলাম, আমার শহরে এমন কোন সতর্কতা নেয়া হয় নি। ভবিষ্যতেও হবেও না, মেয়রসাহেব সেদিন বললেন। তাই এখানে দেদারসে পাগল ঘুরে বেড়ায় রাস্তাঘাটে। বিভিন্ন আইল্যান্ডগুলোতে তারা ছাপড়া ঘর তুলবে কয়েক বছরের মধ্যেই – এমন চালু গুজব তাই ফুটপাত থেকে ঘোর তপ্ত বাতাসে মিশে পাক খাচ্ছে আজকাল। আমি বেশ পরিপাটি হয়ে রাস্তায় বেরুলে টের পাই বাতাসভর্তি গুজবগুলো আমার গালে ঠাশ ঠাশ করে চড় মারছে। মাঝে মাঝে আমাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দেয়ার চেষ্টাও করে, আমি সতর্ক থাকি। কিন্তু আমার শহরের মানুষগুলো তেমন একটা সতর্ক না, তারা প্রায়ই ল্যাঙ খেয়ে আছাড় খায় ফুটপাতের ওপর। অনেকে হন হন করে হাঁটার সময়ে ভুল করে, উড়ে গিয়ে পড়ে রাস্তার মাঝখানে। তখন কোনো এক পাগল চালক বিনা দ্বিধায় গাড়ির চাকাটা ওই মানুষটার পেটের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। ভগ্ন পেট নিয়ে মানুষটা ল্যালব্যাল করে উঠে দাঁড়ালেও বেশিদিন টিকতে পারে না। আমরা অনেকে এই দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আরেকটা জননাঙ্গ কমে গেলো!

এর পরে আছে আরো নানারকমের বিপদ, আর বলবেন না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় খালি ফুটপাতেই পাগল পাওয়া যায়, কিন্তু আসলে এই সব পাগলের পাগলামি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। এরা আমাদের দূর্বলতা বুঝে গেছে। বুঝে গেছে যে আমরা বেশ আত্মবিশ্বাসী। স্যুট টাই পরে আমাদের বুক গর্ব ও টাকার গরমে ফুলে ফুলে উঠছে। প্রতিদিন রাতে আমাদের বেশ ভালো জননকার্য এবং ঘুম মিলছে, তাই আমরা পরদিন সকাল সকাল জগিং করতে পারি। শরীরটাকে ফিট রাখতে আমরা কোনো ছাড় দেই না। তারপরে ঘরে ফিরে ফ্রেশ কমলার জ্যুস খাই আমরা। তারপরে সানস্ক্রিন মেখেটেখে ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে পড়ি। পাগলের এতোকিছু কপালে জুটে না, তাই তারা তক্কে তক্কে জ্বলতে থাকে। হিংসাও করে আমাদের, ঈর্ষাও করে আমাদের। এই হিংসা, ঈর্ষা, জিঘাংসা মিলেমিশে একটা খিচুড়ি-ক্ষোভ তৈরি হয় তাদের। তারা মাঝে মাঝে আমাদেরকে ওভারব্রিজের ওপর থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। গাড়ি চালানোর সময়ে আমরা একটু বেখেয়াল হলেই এক্সেলেটর চেপে ধরে জোর করে আমাদের গাড়ি-দূর্ঘটনা ঘটায়। এরকম ঘটনা সারাদিন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তাই তো, শহরের বিখ্যাত দৈনিকটির পাতার পর পাতা ভরে থাকে এইসব খবরে। আমরা যারা ধাক্কা খাইনি, বা গাড়ি চালানোর সময়ে দূর্ঘটনায় পড়িনি, তারা আজকাল জগিং করে এসেই খবরের কাগজ ওল্টাই। ভয়ে আমাদের পেটের নাড়িভূঁড়ি সেঁধিয়ে যায়। ওই লোকটা বা সেই লোকটার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম, এটা ভেবে আমরা ভয় পাই।

আমাদের মাঝে আমি সহ অনেকেই এই খবর কাগজ পড়ার কাজটা টয়লেটে সারি। এই শুনুন, নাক সিঁটকাবেন না। প্রাতঃকালীন কর্মটিকে অবহেলা করবেন না। নিষ্কাশ না হলে খাওয়া দাওয়া ভালো হয় না, জানেন? নিয়মিত সেই কর্মটির সুবিধা করতে খবরের কাগজ বেশ উপাদেয় প্রভাবক। এটা আমাদের বৃহদান্ত্রকে ভয় পাইয়ে দেয়, ওই যে বলছিলাম – নাড়িভূঁড়ি সেঁধিয়ে যাওয়া, সেজন্যেই তো আমরা সুস্থ থাকতে পারি। ধাক্কা খেয়ে তিন তলা উঁচু ওভারব্রিজ থেকে পড়ে যাওয়া মানুষ বা রাস্তার ফুটপাতের পাশে দুমড়ে মুচড়ে থাকা টয়োটা গাড়ির চালকের জীবন আমাদের কাছে ইউসুফগুলের ভূষি হয়ে উঠেছে ইদানিং। আমরা খুশি হই, কিন্তু এটা ভুলে যাই যে পাগলেরা ধীরে ধীরে জিতে যাচ্ছে। কে বলেছে, “সহিংসতা নিরুপায়ের শেষ অস্ত্র”? আমি তো দেখছি, পাগলেরা সহিংসতার পিঠে লাগাম দিয়ে দিব্যি আমাদের কোণঠাসা করে ফেলছে।

আর গত কিছুদিন ধরে নতুন পদ্ধতি শুরু করেছে চালাক পাগল-গোষ্ঠী। রক্তারক্তির ঝামেলায় না গিয়ে তারা এখন ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে ছিনতাই শুরু করেছে। যাবার সময়ে ওয়ালেটের পাশাপাশি তারা আমাদের সকল জরুরি কাগজ, আর গোপন খবর নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরা এমন দুয়েকটা বিছিন্ন ঘটনায় খুব একটা বিচলিত হই নি। উটকো সন্ত্রাস ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু একদিন হুট করে দেখা গেলো, ছিনতাই হওয়া লোকটা পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম (এখানে তার পরিচয় প্রকাশ করছি না)। জানতে পারলাম তিনি গত সপ্তাহের রবিবার রাতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন। শহরের খুব দামি এলাকায দিয়ে ফেরার সময় তার ছিনতাই ঘটেছে। কয়েকজন দুরাত্মা তার মানিব্যাগ, ব্রিফকেইস এবং মুখের চামড়া তুলে নিয়ে চলে গেছেন। নাঃ, ভয় পাবেন না, শিউরে উঠবেন না। মানিব্যাগ আর ব্রিফকেইসটাই দুশ্চিন্তার কারণ, চামড়া তো দুয়েকদিন গেলেই আবার গজিয়ে ওঠে। (আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এটাই এখানে প্রথা)।

তো, যা বলছিলাম, রবিবার রাতে ছিনতাই হলেন তিনি। বাড়ি ফিরলেন ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায়, তার স্ত্রীটিকে দেখা গেলো বেশ ব্যস্ত হয়ে তার পরিচর্যা শুরু করতে। মানিব্যাগ ও ব্রিফকেইসের শোকে তিনি তখন মৃতপ্রায়। ধীরে ধীরে স্ত্রীর উৎকণ্ঠার সামনে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। মানসিক যন্ত্রণার প্রকোপে কেঁদেই ফেললেন প্রায়, স্ত্রীটিও ব্যাকুল হয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন, “কেঁদো না লক্ষ্মীটি, সব ঠিক হয়ে যাবে”। চামড়াহীন মুখে জর্জেটের শাড়ি ঘষা লাগছিলো, লোকটির আর সহ্য হলো না, “ছাই ঠিক হবে, মুখপুড়ি। চুপ কর্‌! তুই ক্যামনে জানিস আমার কতো ক্ষতি হলো?” স্ত্রীটি বেশ থতোমতো খেয়ে গেলেন, চুপ করে উঠে গেলেন। যাবার আগে লোকটির ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে গেলেন। সে রাতটি তারা দুজনেই সঙ্গমহীন কাটালেন। আমিসহ বাকিরা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, আরেকটি বন্ধ্যা রাত কেটে গেলো।

সোমবার পেরিয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত লোকটির চামড়া ঠিক হয়ে এলো, সেই সাথে মনের গভীরের ভয়টুকু কমে আসতে লাগলো। ইনস্যুরেন্স থেকে তার ব্রিফকেইসের কাগজপাতি উদ্ধার করতে পারলেন, ভাগ্যি সবকিছু ব্যাকআপ রাখা ছিলো! মানিব্যাগের শোক সহজে সারার না, তাই সেই শোক মনে চেপেই তিনি শহরের বিখ্যাত বারে রাত একটা পর্যন্ত মদে চুর হয়ে রইলেন। স্ত্রীটির কাজ এই সময়ে বেড়ে গেলো, রাত দুটোর দিকে দেখা গেলো তিনি বার থেকে মদে ঢুলু ঢুলু স্বামীটিকে টেনে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি নিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছেন। উবু হয়ে জুতো ও মোজা খুলে দিচ্ছেন, টাই খুলছেন ও হাত ঘড়িটিও খুলছেন। এসব খুলতে খুলতে তার থরো থরো হাত ও বুক আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। আমাদের ভালো লাগে, “আহা, কতোই না পতিব্রতা স্ত্রী! ব্যাটার আসলেই রাজভাগ্যি।”

হঠাৎই শুক্রবার নাগাদ ছিনতাইকারী পাগলদের পুরো চক্রান্ত লোকটি বুঝতে পারলেন। টের পেলেন যে কেবল ছিনতাই করেই তারা ক্ষান্ত হয় নি, আরো বড়ো ক্ষতি ঘটে গেছে তার। সেদিন আর সব শুক্রবারের মতোই তিনি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছিলেন। জগিং সেরে এসে কমলার জ্যুস খেয়েছেন। তারপরে খবরের কাগজখানা বাগিয়ে টয়লেটে ঢুকে গেছেন। পাগলদের হাতে মানুষের হত্যার খবর পড়তে পড়তে চুক চুক শব্দও করে থাকবেন হয়তো! তারপর “আমি একটু বাইরে থেকে আসছি” বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। সারাদিন তিনি বেশ কিছু জায়গায় গেছেন, যেগুলোর বিবরণ আমরা জোগাড় করতে পারি নি।

সন্ধ্যার পরে তাকে আমরা দেখতে পেলাম সেই বারে বসে আয়েশ করে মদ গিলছেন। আমরা ভাবলাম, এখন প্রায় ঘন্টা কয়েকের জন্যে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি আর কোথাও যাবেন না, এখানেই রাত একটা পর্যন্ত মদ খাবেন। আমাদের অনুমান ভুল হয় নি, রাত একটার দিকেই দেখা গেলো তার স্ত্রীটি আবার তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা দেখি ফাঁকা ফাঁকা রাস্তাটা ফটাস করে দুই খণ্ড হয়ে গেলো, যেন নীলনদ। আমরা দেখি মাথার ওপরে জ্বলতে থাকে স্ট্রীট লাইটগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সেই আলোতে স্ত্রীটিকে আমরা চিনতে পারি না। আমাদের ভুল হয়, আমরা মনে করি কাঠের স্বামীকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

রাত বিড়ির মতো দ্রুত শেষ হয়ে আসে। আর গিসগিস করতে থাকা শহরে একটু পরে বিড়ির মোথার মতো রাতের শেষ পরশটুকু পড়ে থাকে। শনিবার আরো একটা ছুটির দিন হয়ে খুব কষ্ট করে জেগে উঠতে থাকে, আমি হঠাৎ টের পাই যে পাগলেরা রাতে ঘুমায় নি। আমরা খুব নিশ্চিন্তে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম, আর পাগলরা সারা রাত জেগে ছিলো ফুটপাতে ফুটপাতে। তাদের জন্য আমার কেন জানি সেই সকালে একটু মায়া হয়। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের প্রতি মায়া দেখানো একেবারেই নিষিদ্ধ, তবু আমি চুরি করে একটু মায়া দেখাই। এক পলকের জন্য ভুলে যাই যে এরা আমাদের শত্রু। হঠাৎ চোখে পড়ে, সেই বিখ্যাত বারের পেছনের দরজার কাছে একটা শরীর দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। শরীরটি যে বেশ ব্যায়াম করে নিয়মিতই, তা বুঝতে পারি। আরো বুঝতে পারি, সেটি কোন পাগল নয়। পরিপাটি শার্ট, ঢিলে না হওয়া টাইয়ের কোনা দেখা যায়, প্যান্টখানাও নিপাট। দোকানের লোকগুলো ঘুমুচ্ছে হয়তো এখনো। তাই আমার কৌতূহল বাড়তে থাকে। চেহারাটা দেখতে পারছি না, শরীর উল্টে পড়ে আছে অ-পাগল।

আরো প্রায় ঘন্টাখানেক পরে লোকটির ঘুম ভাঙলো। যেন অচৈতন্য থেকে সে একটু একটু করে জেগে উঠছে। হাত পেঁচিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম আমাদের ছিনতাই হয়ে যাওয়া লোকের মুখ। হুবহু একই চোখ, একই চোয়াল, একই এলোমেলো হয়ে থাকা চুল। চমক ভাঙতে না ভাঙতেই বুঝতে পারলাম গত রাতে এই লোকটি বাসায় ফেরে নি। গত রাতে সে এই বারের পেছনের দরজার বাইরে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলো। আমিসহ আমাদের ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়। এটা আমাদের সতর্কতার পূর্বাবস্থা। খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টা বুঝে গেলাম বলে আমি বাকিদের সাথে বেশ উত্তেজিত স্বরে কথা বলতে শুরু করি। তাদের বুঝাতে চেষ্টা করি যে এক গভীর ষড়যন্ত্র ঘটে গেছে রাতের আধারে। আমাদের শহরের পাগলেরা একটা বিরাট চাল চেলেছে, একই চালে তারা আমাদের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। এখনই সময় আমাদের সতর্ক হওয়ার!

মানুষের দলের আমাদের মাঝে অনেকেই আমার কথা মানতে পারলো না। আমি যে অবিশ্বাস্য কথা বলছি, আমি যে উদ্ভট কথা বলছি সে বিষয়ে অনেকেই তখন নিঃসন্দেহ। তাদের চোখে আমার আচরণ কিছুটা অপ্রকৃতস্থ বলে মনে হচ্ছে — এই কথাও ব্যক্ত করলো কেউ কেউ। আমি অসহায় বোধ করলাম। পাগলদের সাথে যুদ্ধে আমরা হেরে যাবো, এই ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আমার বিপন্নতা বেড়ে গেলো। আমি জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলাম কী বিপর্যয় ঘটে গেছে। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ব্যাপারটা, তাও কেউ কেন বুঝতে চাইছে না? আশ্চর্য!

তারা খুব দ্রুত একটা সভা করে নিলো আমার অভিযোগ নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতি যাচাই করে আমাদের নেতারা বললেন প্রমাণবিহীন এই অভিযোগ সত্যি হবার সম্ভাবনা খুবই কম। বলতে গেলে নগণ্য। তাই আমার এই অতি-আশঙ্কা, এই অতিকল্পনার কোন ভিত্তি নেই। আমি যে এমন পাগলের মতো আচরণ করছি, এটাই এক ধরণের অসুখ। পাগল হয়ে যাবার আগে এরকম উপসর্গ দেখা দেয়। এই শহরে এরকম সময়ে কোন চিকিৎসা হয় না বললেই চলে। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কতোজনেই তো পাগল হয়ে গেলো এভাবে! তাই সভাসদরা ঠিক করলেন আমাকে অতিসত্ত্বর বিদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। এই শহরে পঁচে পঁচে পাগল হয়ে যাবার আগেই আমার বিদেশে চলে যাওয়া উচিত। সেখানে চিকিৎসালয় আছে। বিশাল সুরম্য অট্টালিকাগুলোকে চিকিৎসালয় বানিয়ে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে পাগলদের চিকিৎসা করা হয়। তাদের ঘুমের বড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। এখানে থাকলে আমাকে সারা রাত জেগে থাকতে হবে, আমি আর সুস্থদের মতো রাতে ঘুমুতেই পারবো না। তারপরে একদিন পাগল হয়ে ফুটপাত ঘেঁষে রাত কাটাবো।

আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমার ভালো চান। তাই আমি মুখ বুঁজে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখের সামনের দৃশ্যগুলো হঠাৎ আমার কাছে সিনেমার পর্দার মতো মনে হয়, ত্রিমাত্রিক মানুষগুলোকে চ্যাপ্টা লাগে, সামনের টেবিল চেয়ারগুলোকে মনে হয় দেয়ালে এঁকে রেখেছে কেউ। সিনেমার মতোই তারা মাথা নাড়ে, ঘন ঘন হাত উঁচিয়ে ঘড়ি দেখে। তারপরে নিজেরা নিজেরা ফিসফিস করে কী কী যেন বলে, আমাদের দিকে তাকিয়ে পেশাদার হাসি দেয়। কাগজের খসখসাখস শুনতে পাই।

আমার চোখে কোন একটা সমস্যা হয়েছে মনে হয়। ঠিক এই দৃশ্যগুলোর ভেতর দিয়েও আমি লোকটিকে দেখতে পাই। বারের পেছনের দরজার কাছে এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখা লোকটিকে না, গতরাতে যে লোকটি স্ত্রীয়ের কাঁধে চেপে চলে গেছে সেই লোকটিকে দেখি। দেখতে পাই গত রাতেও তার স্ত্রীটি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে, তারপরে জুতো ও মোজা খুলে দিয়েছে। সারা রাত লোকটি ঘুমায় নি যদিও, চোখ বুঝে পড়ে ছিলো (আমি নিশ্চিত)। তারপরে সকালে উঠে ঠিকঠাক অভিনয় শুরু করে দিয়েছে।

আমার সামনের সিনেমার দৃশ্যে আটকে থাকা মানুষেরা বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে আমি চেয়ার বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু একটু মাথা দোলাচ্ছি, আর পাগলের মতো হা হা হা করে হাসছি!

****
১২.১১.১০