প্রলম্বিত নরক

গুলশানে আইসিসের জঙ্গি আক্রমণের দুই সপ্তাহ পূর্ণ হলো আজ।

খবরের কাগজে নিহতদের ময়না তদন্তের রিপোর্ট এসেছে। জঙ্গিরা কীভাবে হত্যা করেছে, কতটা পাশবিক নির্যাতন করে মেরেছে তা পড়লাম। আমি খুব শক্ত স্নায়ুর মানুষ। কিন্তু এই রিপোর্ট পড়ে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। হলি আর্টিজান বেকারিতে যারা খুন হয়েছেন, তারা রক্তমাংশের মানুষ ছিলেন। তাদের পরিবার ছিল। বন্ধুবান্ধব ছিল। ভালোবাসার এবং ঘৃণার মানুষ ছিল। তাদেরকে কীভাবে একটু একটু করে মারা হয়েছে সে বর্ণনা পড়তে গিয়ে বিচলিত হয়েছি। নির্বিকার  থাকতে পারি নি। সবচেয়ে বেশি আঘাত করা হয়েছে নারীদের। তাদের সারা শরীরে চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। বাংলাদেশি ছাত্রীটির মাথায় ভারি কোনকিছু দিয়ে আঘাতের লক্ষণ আছে। ভারি কিছুর আঘাত অর্থাৎ সম্ভবত তার মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছিল। সকলের শরীরে, হাতে, পেটে, বুকে ছুরির আঘাতের চিহ্ন আছে। একজন নারীর পেটে ও বুকে তিরিশবার ছুরির কোপ আছে। তিরিশবার! একজন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে আঘাত করার পাশাপাশি তার পেটে থাকা শিশুকেও আঘাত করা হয়েছে। সাত মাসের শিশুর চেহারার আদল বোঝা যায়। মায়ের জঠরের ভেতর মাতৃকা রসে মাখামাখি শিশু নড়ে চড়ে বেড়ায়, মাঝে মাঝে মায়ের পেটে লাথি দেয়। আলট্রাসনোগ্রামে দেখা যায় সে ঘুমের ভেতরেই চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসছে, মাঝে মাঝে পায়ের আঙুল নাড়াচ্ছে, চিকন হাত দিয়ে নিজের মুখে বোলাচ্ছে। মায়ের ভেতরে নিরাপদে, নিশ্চিন্তে ঘুমুতে থাকে এই শিশুকেও ছুরি আর চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।আর শেষ পর্যন্ত এদের বিশ জনকেই জবাই করা হয়েছে। রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝের ছবি আমরা দেখেছি। সেই রক্তে উপুড় ও কাত হয়ে থাকা নিথর লাশের ছবি দেখেছি। এই লাশগুলো কিছুক্ষণ আগেই হাসিখুশি জীবন্ত মানুষ ছিলেন। এরা এক ছুটির দিনের সন্ধ্যায় খেতে গিয়েছিলেন হলি আর্টিসানে। যেমন আমরা সকলেই যাই। তারা কোন যুদ্ধে যান নি, তেমন কোন খবরও পান নি যে দেশে যুদ্ধাবস্থা। কোন আগাম-সংকেত পান নি যে অচিরেই তাদেরকে কোরবানির পশুর চেয়েও নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হবে।

আমাদের সম্মিলিত মননে এগুলো সম্ভবত আর কোন দাগ কাটে না। বলছি  – কেননা মাত্র দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে ফিরে গিয়েছি। মাঝে অবশ্য ঈদের লম্বা ছুটি থাকায় এসব ভুলতে সুবিধা হয়েছে। ঈদে আমরা নামাজ পড়ে পরিবারের সাথে ঈদ পালন করেছি, ঘুরতে গিয়েছি অনেকেই। আমরা টিভির বিভিন্ন চ্যানেলের নাটক দেখে সেগুলো নিয়ে মতামত দিয়েছি! কোন নাটকটি ভাল বানিয়েছে, কোন চ্যানেলে নাটকের মাঝে বেশি বেশি বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেছি, এত বেশি বিজ্ঞাপন দেখায় বলেই নাকি জঙ্গি হয়! কী নিষ্ঠুর অসংবেদনশীলতা! কী অকল্পনীয় অমানবিকতা! মনে হচ্ছে আমরা বোকাবাক্সের সামনে বসে থাকা জাবর কাটা গবাদি পশুবিশেষ। যারা কেবল নিষ্পলক টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকি মিডিয়া পর্নোগ্রাফি। দেখতে থাকি জঙ্গিদের বাবা-মায়ের অশ্রু – আহা রে, তার এত সুন্দর চেহারার ছেলেটি ভুল বুঝে ভুল করে জঙ্গি হয়ে গেছে। একটু ভালোবাসা, একটু সহমর্মিতা পেলেই হয়তো তারা জঙ্গি হতো না। এগুলো দেখি আর শুনি আর মাথা নেড়ে একমত হই। অথবা আমরা ক্রাশ খাই এইসব জঙ্গিদের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি দেখে! আমাদের মিডিয়া বারবার তাদের আইসিসের কালো পতাকার সামনে বন্দুক হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিগুলো পুনরুৎপাদন করতে থাকে। এরই মাঝে জাকির নায়েকের মতো একটি আধুনিক ভণ্ড পীরের চ্যানেল নিষিদ্ধ করায় যে যার সুবিধামতোন ফেসবুক উত্তপ্ত করেছি। ধারণা করি যে, এতে কর্তাব্যক্তিরাও খুশি হয়েছেন। ভালই হয়েছে, জঙ্গিবাদের ঘটনায় একটি চমৎকার কাকতাড়ুয়া পাওয়া গেছে! এটাকে ঝুলিয়ে রাখলে জঙ্গি পাখিরা হয়তো আর ক্ষেতে হানা দিবে না। আর আমরা ক্ষেতের অধিবাসীরাও নিশ্চিন্তে রাতে ঘুরতে যেতে পারবো যমুনা ফিউচার পার্কসহ বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়। একপক্ষে জাকির নায়েকের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছেন কেউ কেউ, অন্যপক্ষে জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন বাকিরা। এক ভ্রূক্ষেপহীন প্রবল উৎসাহে আমরা তর্কে মেতে উঠেছি জাকির নায়েককে নিয়ে, হয়তো এই তর্ক থেকেই আমরা প্রমাণ করে দিব যে দেশে জঙ্গিসমস্যার সমাধান একমাত্র আমার কাছেই আছে! প্রথম দলটি জাকির নায়েকে সমস্যা দেখেন না, বরং অন্যান্য আরো অংশের মধ্যেই জঙ্গিবাদের মূল আছে বলে মনে করেন। দ্বিতীয় দলটির মতে একমাত্র জাকির নায়েকের পিস টিভিতেই লুকিয়ে আছে প্রাণভোমরা। হয়তো আমাদের দুই দলের জন্যই জাকির নায়েকে মনোযোগ দেয়াটা সুবিধাজনক। কারণ আমরা জঙ্গিবাদ সরীসৃপের পিচ্ছিল শরীরে হাত রাখতে ভয় পাই।

ধরে নিচ্ছি সবাই এত সহজে মানিয়ে নেন নি। কেউ কেউ হয়তো এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে আসলেই প্রভাবিত হয়েছেন, নাড়া খেয়েছেন। তাদের জন্য এই লেখা। অতি বেদনার সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, “ওয়েলকাম টু দ্যা ক্লাব”। আপনি যদি গত দেড়-দুই বছরের জঙ্গি হত্যাগুলোতে প্রভাবিত না হয়ে থাকেন, এবং এতদিনে গুলশানের ঘটনায় বিচলিত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে স্বাগতম জানাই “প্রলম্বিত নরকে”। আমরা গত দেড়-দুই বছর ধরেই এই প্রলম্বিত নরকে বসবাস করছি। আপনি নতুন যোগ দিলেন। প্রথমেই এই নরকের চারপাশটুকু চিনিয়ে দেই। এই নরকে পৃথিবীর কদর্যতম ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। এখানে আপনি কিছুদিন থাকলে সেগুলো দেখতে পারবেন। দেখবেন কীভাবে কর্তাব্যক্তিরা এসব খুনকে ধামাচাপা দিচ্ছেন। দেখবেন কীভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ছেলে, তাঁর ক্যাবিনেট, তাঁর দল, তাঁর পুলিশ, তাঁর গোয়েন্দারা ধীরে ধীরে নিহতদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন। জানতে পারবেন “ঠাকুরঘরে কে রে, আমি কলা খাই না”র ঢঙে তিনি ও তার সম্পর্কিত সকলেই বলছেন ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম, জঙ্গিরা আসলে মুসলমানই নয়! দেখবেন কীভাবে কিছু কিছু দলীয় বুদ্ধিজীবী নানাভাবে সেই অবস্থানের জাস্টিফিকেশন করছেন। এঁদের কাউকে কাউকে হয়তো আপনি আইডল ভাবতেন, ভরসাস্থল ভাবতেন। এখন তাঁদের কলাম আর অপিনিওন পিস দেখতে তাঁদের মুখের ওপর মুতে দেয়ার অক্ষম ইচ্ছা করবে আপনার।

তারপর দেখবেন সবাই যে যার বলয়ে ফিরে গেছেন। নির্লজ্জের মতন নিজ জীবনের তুচ্ছ অর্থহীন ভোগ আর বিলাসের প্রচার করছেন। দেখবেন হাজার হাজার সেলফি আর লক্ষ লক্ষ চেকইন। আপনিও হয়তো একসময় নির্লজ্জ হয়ে তাদের লাইক দিয়ে বেড়াবেন। সমস্যা নেই। তবে এই নরক থেকে বের হতে পারবেন না। কোন কোন রাতে ভয়ানক দুঃস্বপ্নের ভেতরে দেখবেন আপনার বন্ধুর হাসি হাসি মুখের ওপরে এসে চাপাতি দিয়ে কোপ দিচ্ছে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা কয়েকজন। এই দুঃস্বপ্ন দেখে আপনার ঘুম ভেঙে যাবে। রক্তব্যাকুল চোখের সামনে সেই পরিচিত বন্ধুর রক্তমাখা বিকৃত মুখের হাসি ঝুলতে থাকবে।

বুদ্ধিজীবীদের এড়াতে পারলেও আপনার ফ্রেন্ড লিস্টের “বন্ধুদের” এড়াতে পারবেন না। এরা একেকজন বিভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে মতামত দিবেন। একজন নাস্তিক এসে বড় একটা স্ট্যাটাসে আচ্ছাসে ধর্মকে ধুয়ে দিবেন। একদম তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের আলাপ। সেই আলাপে যত না আইসিসের জঙ্গিবাদ ঠেকানোর বা চিহ্নিত করার চেষ্টা, তার চেয়ে বেশি কতগুলো বই পড়ে তিনি নাস্তিক্যবাদ শিখেছেন সেই বারফাট্টাই। ওদিকে আসবেন একজন তথাকথিত মডারেট মুসলিম, যার তালগাছ হলো ইসলাম ধর্ম একটা শান্তির ধর্ম। যে যাই বলো এই ধর্ম নিয়ে কিছু বলা যাবে না। এমনকি আইসিস যে এই ধর্মের অনুসারী, সেটা বললেও তিনি গোস্বা করবেন। এরপর আরেকজন আসবেন যিনি কট্টরভাবেই ইসলাম ধর্ম মেনে চলেন। আপনার দুর্ভাগ্য বেশি হলে, ইনি একজন সরব মুসলিম। যিনি কোরান-সুন্নাহর জিহাদী আয়াত ও বাণীর মডার্ন ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে চলেন। তার বর্ণনা পড়ে প্রমথ চৌধুরির “সাহিত্যে খেলা” অথবা বঙ্কিমচন্দ্রের “রচনার শিল্পগুণ”কেও জলবৎ তরলং মনে হবে। আপনার সন্দেহ হবে, এই বন্ধু রবীন্দ্রনাথের “সোনার তরী” কবিতারও নতুন কোন ইন্টারপ্রিটেশন বের করে ফেলতে পারে! এমন নানাবিধ বন্ধুর চাপে আপনার ত্রাহি মধুসূদন দশা। তখন মনে হবে এর চেয়ে বিশ্বচরাচর-অগোচর নির্বোধ বন্ধুটির সেলফিগুলোই বরং ভাল ছিল।

যত যাই করুন না কেন, এই প্রলম্বিত নরক থেকে আপনার মুক্তি নেই! গুলশানের জঙ্গিগুলোর প্রতি ফেটিশাক্রান্ত আবেগ থেকে যে ছোট বরফের কুণ্ডে আপনি পেঁচিয়ে যাচ্ছেন, সেই বরফখণ্ড ধীরে ধীরে বড় হবে! আপনি জানবেন অপারেশন থান্ডারবোল্টের অনেক আগেই বিশজন নিরীহ মানুষকে জঙ্গিরা কুপিয়ে মেরে ফেলেছিল। আপনি জানবেন একেকটি নারীর লাশে তারা বারবার ছুরি দিয়ে কুপিয়েছে। আপনি দেখবেন নিহতদের একজন আদৌ আক্রান্ত নাকি জঙ্গি সেটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে, কারণ তার নানা একটা পত্রিকার মালিক। আপনি আরো দেখবেন শত শত তরুণ জঙ্গিদের মতই ঘরছাড়া নিখোঁজ। আপনি দেখবেন কীভাবে সরকারের পাশাপাশি জঙ্গিদের বিশ্ববিদ্যালয় তাদের হাত ধুয়ে উঠে পড়ছে। দেখবেন একে একে সকলেই এপোলজেটিক হয়ে উঠছে। প্রবল এপোলজিতে ভরে উঠবে আপনার চারপাশ। কেউ তার ধর্ম নিয়ে, কেউ তার বন্ধু নিয়ে, কেউ তার সন্তান নিয়ে, কেউ তার বড়ো ভাই নিয়ে, কেউ তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে দিকে দিকে এপোলজেটিক কথা বলছে। কেউ জঙ্গির দায় নেয় না। প্রধানমন্ত্রী নেয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নেয় না। আইজিপি পুলিশ নেয় না। বুদ্ধিজীবী নেয় না। শিক্ষক নেয় না। অভিভাবক নেয় না। পিতামাতা নেয় না। বিশ্ববিদ্যালয় নেয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাইরা নেয় না। মডারেট মুসলমান নেয় না। প্র্যাকটিসিং মুসলমান নেয় না। ধর্ম নেয় না। পরিবার নেয় না। সমাজ নেয় না। সম্ভবত স্রষ্টার সাক্ষাৎকার নিলে দেখতেন তিনিও নিচ্ছেন না!

মজার ব্যাপার কি জানেন। এই গুলশানও আবার ফিরে ফিরে আসবে। প্রতিটি গলাকাটা লাশের ওপর আরেকটি নতুন লাশ জমা হবে। প্রতিটি নতুন লাশের পর একই চক্র। সেই লাশের পিছু পিছু আমাদের প্রলম্বিত নরকে আপনার মতই আরও নতুন সদস্য যোগ দিবেন। তাই এখনই হাল ছেড়ে দিয়েন না, বস! সামনে আরো দীর্ঘ দীর্ঘ ঋতুকাল আমাদের এই প্রলম্বিত নরকে কাটাতে হবে। টাইট হয়ে বসেন। মাঝে মাঝে বেশি কষ্ট হলে এই নরকের মাটিতে মুখ গুঁজে কণ্ঠের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করবেন। দেখবেন একসময় ক্লান্ত হয়ে শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। ক্লান্তির মেঘের ওপর দুঃস্বপ্নহীন কয়েক মুহূর্তের ঘুম পেতে পারেন – ওটুকু বোনাস।

প্রলম্বিত নরকের অনন্ত ঋতুতে আপনাকে স্বাগতম! ভাল থাকবেন!