নৈঃশব্দ্যের কথাবার্তা

আলাপ সালাপ স্বগতঃ সংলাপ

Month: অক্টোবর, 2010

এই লেখাটা তার জন্যে…

আরাভ আরীজ হক

সে আসবে জেনে আমি তেমন কোন আবেগ বোধ করি নি প্রথমে। জেনেছি সে আসছে, খুশি হয়েছি যে খুব তাড়াতাড়ি এই অক্টোবরেই তার সাথে দেখা হবে। সে আসলে তার সাথে বেশ খাতির জমাবো ঠিক করে রেখেছিলাম। এমনিতেই আমি বেশ হাসিখুশি মিশুক মানুষ। প্রাথমিক জড়তা থাকে অপরিচিতের সাথে, সেটা কেটে যেতে একটু সময় লাগে। কিন্তু তারপরে আমি ভীষণ মিশে যেতে পারি কারো কারো সাথে। যাদের ভালো লাগে, তাদের দেখলেই ভালো লাগে। তাই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম যে যদি তাকে আমার ভালো লাগে, তাহলে আমি তার সাথে বেশ খানিকটা সময় কাটাবো।

অক্টোবরে বাংলাদেশ খুব সুন্দর হয়ে ওঠে সাধারণত। আমি জানি এই কথার তেমন কোন প্রামাণ্য ভিত্তি নাই। তবে আমার ভালো লাগে। বাংলাদেশ ছোট হতে হতে আমার কাছে এখন খালি ঢাকা শহর হয়ে উঠেছে। আর ঢাকা শহরটাও পুরোটা আমার কাছে নেই, বাসস্থান আর দপ্তরের রাস্তাকতক এদিক সেদিক, দু’তিনটে গাছপালা, কয়েকটা ঘুপচি গলি-উপগলির মোড়, আর অবিরাম যানজট মিলিয়ে এই নগর সংকুচিত এখন। তো যখন অক্টোবর আসে, বৃষ্টি থেমেই গেলো প্রায়। শুকিয়ে এলো ড্রেন নামের নালাগুলো। গাছগুলো একটু হাঁফ ছাড়বার সুযোগ হারালো। ছাতা গুটিয়ে জবুথবু কেরানিগুলো আবার তেলচিটে শার্ট পরে ঘামা শুরু করলো। আমি অবশ্য এগুলোকে তেমন পাত্তা দেই নি। এদের এড়াতে আমি উপরে আকাশের দিকে তাকিয়েছি। তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। থরে থরে শরতের আকাশের হুবহু নকল যেন! অথচ এখন হেমন্ত যায় যায়। ধানক্ষেত তো নেই আশেপাশে, তাই টের পাই না কার্তিকের ঘ্রাণ। খালি সিএনজি গ্যাসে ভরা গাড়ি নাকে ঢুকে যায়। তেল পোড়ে হেঁশেলে, গ্যাস স্টেশনে। মাঝে মাঝে অক্টোবরের বিকেলে বাতাস নামে শহরে, আমি সে সময়ে ঘরের বাইরে থাকি বলে টের পাই… শহরটা গিজগিজ করছে দীর্ঘশ্বাসের তৈরি মানুষে। এই মানুষের ভীড় একেবারে খারাপ না – বৈচিত্র্যময় দারুণ।

তারপরে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে সে আসছে। একদিন হঠাৎ জানতে পেলাম গভীর শেষ রাতে আসবে সে। যখন খবর পেলাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারো পার। আমি ঠিক করলাম যে খুব ভোরে উঠে তার সাথে দেখা করতে যাবো। ততোক্ষণে সে নিশ্চয়ই বেশ ধাতস্থ হয়ে যাবে ঢাকা শহরের চারপাশে। ‘ভালোই হবে’, ভেবে আমি ‘ঘুমুতে গেলাম, যাচ্ছি’ করছিলাম। ঠিক তখনই ফোন এলো যে জরুরি খবর – সে আসছে সময়ের একটু আগেই। আমি তড়িঘড়ি তৈরি হলাম, দেরি করা যাবে না। রাতের ঘুমের নিকুচি – তার সাথে দেখা করেই ঘুমাবো ‘খন। সাথে করে ক্যামেরাখানা নিয়ে বের হলাম, যদি তার সাথে প্রথম দেখার সময়টা ধরে রাখতে পারি তো বেশ হয়।

মধ্যরাত পেরিয়ে পৌঁছালাম হাসপাতালে, জরুরি বিভাগ – কাচের দরজা – খুলে ঢুকতেই দেখি কান্নার শোরগোল। একটু আগেই একজন প্রৌঢ় স্ট্রোক করে মারা গেছেন। হাসপাতালে আনতে আনতেই ভবলীলা…। তার পুরো পরিবার শোকে থরথর। মনে একটু কু-ডাক দিলো। মৃতের পরিবারের একজন আবার আমার ভাইয়ের পরিচিত। টুকটাক কথা বিনিময় হলো। আমরা শোকার্ত পরিবার পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। কু-ডাক লাপাত্তা হলো তার মায়ের মুখ দেখে। তিনি বেশ চুপচাপ। অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তাটুকু প্রকাশ করছেন না। আমি সেই মা হতে চলা আপুকে ডাকি পলিটিশিয়ান, আমার বেশ বড়ো তো, তাই আপুর বুদ্ধিতে বরাবরই ধরা খাই। বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। উৎকন্ঠা কমে না। প্রক্রিয়াটাই ঝুঁকিপূর্ণ সবসময়। কয়েকবার করে ডাক্তার দুইজনের সাথে কথা বলে বলে একটু শান্ত হওয়া গেলো।

রাত ধীরে ধীরে চুইংগামের মতো লম্বা হচ্ছে। সেই রাতটুকুকে চিবুতে চিবুতে হঠাৎ খেয়াল করলাম প্রায় দুইটা বাজে। একটু খিদে লেগে গেলো। লাজশরমের মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আর কারো পেট ডাকছে নাকি। পেটুকের দলের কোন লজ্জা থাকে না, এই বাক্য প্রমাণ করে ভাই, দুলাভাই ঈষৎ মাথা দুলালো। সে আসুক, নির্ভার হয়ে খাদ্যের ভার নেয়া যাবে। এই অপেক্ষার মধ্যে হাসপাতাল নিশ্চুপ। লোকজন নেই, আমরা কয়েকজন বসে রইলাম। আমি, আপুর ছোটভাই, দুলাভাই, আপুর মা-বাবা-শাশুড়ি। আপুর মা বাবা দুইজনই এই প্রথম নানা নানি হতে চলেছেন। তাই তাদের উদ্বেগ কয়েক হাত দূরে বসেও দিব্যি টের পাচ্ছি। আমি একটু হাল্কা করতে আপুর মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার সাথে তার কীভাবে দেখা হলো। শুনে একটু হাসলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘তোকে দেখে প্রথমে বুঝতেই পারি নি। হাসপাতালের কেবিনে এসে দেখি কাঁথার ওপরে একটা বাবু হাত-পা ছুঁড়ছে। ভেতরে গিয়ে তোর মায়ের দেখা পেলাম, তারপরে সে জানালো বাইরের ঘরে রাখা কাঁথার ওপরের মানুষটাই তুই।’ একটু হাসলেন তিনি। অনেক বছর আগের কথা মনে পড়ে গেলো তার। ভালোই হলো, একে একে বাকিদের খবর বেরিয়ে এলো। কে কীভাবে এসেছে, আপুর মায়ের সব মনে আছে। আমি এক মনে শুনছিলাম।

একটু পরে দুলাভাইকে ডেকে নিয়ে গেলো ভেতরে। সময় হয়ে গেছে তার আসার। আমরা দ্বিগুণ উৎকণ্ঠায় বাইরে পায়চারি করছি। আপুর ভাইটা একটু বেশিই অস্থির। ঢোক ঢোক পানি খাচ্ছে, কারণ যদি রক্ত দেয়া লাগে। পানি খাওয়া শুরু হয়েছে সন্ধ্যা রাত থেকেই। এই কারণে একটু পরে পরে নিম্নচাপ – ‘এক্সকিউজ মি, বাথরুমটা কোন্দিকে?’ আমি বললাম, ‘একটু সুস্থির হয়ে বোস। সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে।’ ঝামটা এলো উত্তরে, ‘আরে তুমি জানো কচু। সাবধানের মাইর নাই। রেডি থাকা ভালো।’

অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা একটু খুলে ছিলো। আমি বুদ্ধি করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যদি আওয়াজ পাওয়া যায়, সে এলেই টের পাবো। মাঝে মাঝে আপুর বাবাকে দেখছি খালি করিডোরে পায়চারি করছেন। হাতে তসবি, নিবিষ্ট চোখে প্রার্থনা।

হঠাৎ একটা চিল চিৎকার। রাতের সময় বলে চারিপাশে আর কোন সাড়াশব্দই নাই। ‘সে কি এলো?’ আমরা একটু শশব্যস্ত হয়ে উঠি। ভেতর থেকে একজন দ্রুত বেরিয়ে পাশে NICU -তে ঢুকে পড়লো। ‘নাটক করছে কেন এরা, বলে দিলেই পারে!’ ভেতর থেকে সাড়া নেই। অস্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে। চিৎকারটা একটু পরে আবার শোনা গেলো, স্পষ্টতর, সুতীক্ষ্ণ। ‘সে কি এলো?’

আপুর মায়ের চোখে একটা হাসি ঝিলিক দিয়েই উদ্বেগের ভারে চাপা পড়লো। আপুর বাবার হাতের আঙুলে তসবি শ্লথ। আরো তিনচার মিনিট পেরিয়ে গেলে দুলাভাই বেরিয়ে এলেন। মুখে হাল্কা নীল মুখোশ। চোখে হাসি। মাথাটা হাল্কা উপরে নিচে দুলিয়ে বললেন, ‘ছেলে’।

আপুর বাবা তখন একদম তৈরি, আজান এই দিলেন বলে। নার্স জানালো আরেকটু অপেক্ষা করেন। নিয়ে আসি তাকে। ‘বাচ্চার মা কেমন আছে?’ ‘এখনো সেন্সলেস, তবে স্টেবল’। পাথর চাপা দুশ্চিন্তা ফুরফুরিয়ে উড়ে গেলো!…

থিয়েটারের ভারি কাচের দরজা ঠেলে সে বেরিয়ে এলো, এসে ড্যাবড্যাবে চোখে টিউব লাইট দেখছে। এতো রাত হয়েছে, কিন্তু ঘুম নেই দেখি! সারা শরীর আঁটোসাঁটো কাঁথায় মুড়ানো। মাথায় তুলোট টুপি। গোলগোল রক্তাভ গাল, ছোট এক্টুস পাতলা ঠোঁট। আর বড়ো বড়ো চোখ। পুরো চোখ খুলতে পারছে না সে। আর একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে শীতে। আমি বেশ কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সে বেশ অদ্ভুত দৃষ্টি দিলো এক পলক। তারপরে অন্য দিকে চাইলো একটু। এদিক সেদিক। জঠরের উত্তাপ খুঁজছিলো বোধহয়। তাই তাকে আবার ভেতরে নিয়ে গেলো নার্সটা।

তাকে এক পলক দেখেই আমার মনে হলো তার সাথে আমার আরো অনেক অনেক বার দেখা হবে। কিন্তু তার বিশ মিনিট বয়সের সেই পরিচয়ের মুহূর্তটা আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। সাক্ষাতে দুইপক্ষের সমান আগ্রহ বা মনোযোগ থাকে না জানি। এই সাক্ষাতটাও তেমনি। সংক্ষিপ্ত – সরল – সরাসরি। এই লেখাটা তার জন্যে। অক্টোবরের আধা রাত আধা ভোরে যে এই শহরে এলো, এবং এখন থেকে সে এখানে জল-কাদা-বাতাসে বড়ো হয়ে উঠবে। তার জন্যে।

একটু পরে ফুরফুরে মনে আমরা তিন জন, খেতে বেরুলাম। পেটে ইদুর ডনবৈঠক দিয়ে অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে। তারে দাফন করে আমরা বেশ খানাদানা করলাম। খাবারের দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তার মাথায় পুব দিকে দেখলাম সূর্যলাল হয়ে উঠছে। মেঘগুলো রঙচঙে হয়ে গেছে বেশ। এতো সাজ! পাখির কিচিরমিচির। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ভাঙা ভাঙা আলো। পৃথিবীতে আজ সুন্দর ভোর…

এই সুন্দর পৃথিবীতে তোকে সুস্বাগতম জানাই…!!!

*****

পাখি মন্ত্রণা

আর কতোকিছুই তো ভালো লাগে কাঁপনে মিশে থাকে এইসব দিনরাত্রির গান অজস্র কোলাহল আন্তরিক টানটান হলাহল ডুবে থাকে চুলের ভেতর, মৃদু সৌরভ…

আমাকে প্রায়ই অনেকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কেমন আছি। আমি খুব সরলমুখে বলে দেই, আমি ভালো আছি; অথবা বলি, এই তো চলতেছে; কিংবা বলে ফেলি, ভালোই আছি। এরকম বেশ কিছু টেমপ্লেট জবাব তৈরি থাকে – বলে ফেলতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না। তারপর ভুলে যাই, অন্য বিষয়ে চলে  যাই। তাকেও হয়তো পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম,  সেও ভালো থাকার কথা জানিয়ে দেয়। আমরা দুইজনেই তখন ভালো থাকতে থাকতে অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে আলাপ করি। আমাদের তুচ্ছ ভালো লাগার চাইতে এইসব মানুষিক ব্যাপার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

ঠিক সেই মুহূর্তে হয়তো কোথাও বাজ পড়ে। হয়তো কোন একটা গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ে, ডালের খাঁজে বাসা বেঁধেছিলো কোন খয়েরি পাখি, বাসার ভেতরে ছিলো তিন চারটে নতুন শিশু পাখি। ডাল ভেঙে যখন মাটিতে নেমে আসে, পাখিগুলো উড়ে চলে যায়… দূরে, অনেক অনেক দূরে…! এই পাখিরাও ভালো থাকে হয়তো, আমার সাথে যদি দেখা হতো, তাহলে আমি তাদের প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, কেমন আছেন? তারা স্মিতমুখে বলতো, ভালো আছি। আপনার কী খবর? আমি হাতে একটু ভঙ্গি করে বলতাম, ‘এই তো চলতেছে’।

পাখিগুলো মারা গেছেন সবাই। মৃতের সরকারি সংখ্যা ৪, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি ডালে বসবাসকারী পাখি জানিয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা ৫। সরকার একটি পাখির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে নাই।  তারা মনে হয় ভুলে গেছে গুনতে। আমি তাদের ভুল ধরিয়ে দেবার জন্যে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে ফোন দিলাম।  অনেকক্ষণ রিং হচ্ছিলো, কিন্তু কেউ ধরছিলো না। ঘাম-শুকানো দুপুরে আমি চাতালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কানে রিসিভার চেপে ধরে রাখলাম। একঘেঁয়ে স্বরে রিং বাজছে, ট্রিং ট্রিং…

এভাবে অনেকক্ষণ, জানি না ঠিক কতোক্ষণ, রিং বাজার পরে একজন ফোন ওঠালেন। আমি চমকে গেলাম, কানের ভেতরে বাজতে থাকা ট্রিং ট্রিং ততোক্ষণে মাথার ভেতর বাজতে শুরু করেছে। সেই বাজনায় চকিত ছন্দপতন। ‘হ্যালো’, খ্যানখ্যানে স্বর শুনে একটু দমে গেলাম। আমি ফোন করেছি সরকারি হিসাবের ভুল ধরতে। যে লোকটি ফোন ধরেছে সে একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমি পরিষ্কার দেখছিলাম লোকটা পেটমোটা কুমড়োপটাশের মতো। একটু আগে দুপুরে ভাত খেয়ে এসেছে, সাথে ঝোল ঝোল তরকারি আর সবজি ছিলো। ভাত খেয়ে মোড়ের দোকান থেকে একটা পান কিনেছে। পান চিবাতে চিবাতে এসে আয়েশ করে চেয়ারে বসে ফোন ধরেই গলা খাকারি দিয়েছে, ‘হ্যালো’। মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয়ে তেমন কাজ নেই বোধহয়! তাই তারা এতো ঢিলাঢালা।

আমি বললাম, ‘আমি আপনাদের ডিপার্টমেন্টের একটা ভুল রিপোর্ট নিয়ে ফোন করেছি’, একটু থেমে আবার বলি, ‘গতকাল খবরে মৃত পাখির সংখ্যা ভুল বলেছেন আপনারা, আসলে মোট ৫টা পাখি মারা গেছেন – আপনারা লিখেছেন ৪টা। একটা পাখির হিসাব দেন নি’। লোকটা বোধহয় একটু অবাক হয়ে গেছে, পান চিবানোর শব্দ পেলাম না, বরং দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলল, ‘হতে পারে একটা পাখির হিসাব মিলে নাই। তাতে কি হইছে? গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’

 

তার তীব্র স্বরে আমি মারা গেলাম। প্রশ্নটা অশ্লীল লাগছে। প্রশ্ন করার ফাঁকে তার দাঁত চিবানো বা পান চিবানো অশ্লীল লাগছে। রিসিভার বেয়ে কানে পৌঁছে যাওয়া তার কণ্ঠস্বর অশ্লীলতায় থকথক করছে। আমি যে হাতে রিসিভার ধরে ছিলাম, সেই হাতটাকে কোনো ঘিনঘিনে কমোডের ভেতরে ডুবিয়ে রেখেছি বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এই প্রবল অনুভূতিগুলো আমাকে মূক করে রাখলো। টেলিফোন সেটটায় কি কোন সমস্যা আছে? লোকটা ফোন ধরার আগে কানে ট্রিং ট্রিং প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো। আর এখন তার শেষ প্রশ্নটা গনগন করছে কানের ভেতর।

‘গাছের ডালে পাখির বাসা, বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’

‘বাজ পড়ে পাখি মরছে, আপনের কি?’

‘আপনের কি?’

‘কি?’

আমি একদম নিথর হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বাইরে স্তব্ধ দুপুর আর ঘোলাটে হলদে আলোটা অনেকটা সময় আমার সাথে স্থির হয়ে থাকলো। তারপরে প্রশ্নটা আমার ফুসফুসে পৌঁছে গেলে আমি রিসিভার আলতো করে নামিয়ে রাখলাম। তারপরে চুপ করে বসে রইলাম। পাখিটি মারা গেছেন। পাখিটি বাজ পড়ে গতকাল মারা গেছেন। আজকে মৃত-পাখি-হিসাব মন্ত্রণালয় তাকে ভুল হিসাব করে গোনায় ধরে নি। পাখিটি ডালের ফাঁকে পাতার গভীরে শুয়ে আছে। তার পেলব বুকে একটা স্পন্দনও আর বাকি নেই। কয়েকটা সবুজ পাতা পুড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। আরো কিছু পাতা এখনও সবুজ হয়ে আছে।

 

হঠাৎ কেমন বাতাস হলো, মৃদুমন্দ শিহরণ। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবুজ পাতা কয়টি পাখির স্পন্দনহীন দেহটিকে ঢেকে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।