নৈঃশব্দ্যের কথাবার্তা

আলাপ সালাপ স্বগতঃ সংলাপ

Month: জানুয়ারি, 2010

মুখবন্ধ

হ্যাং হয়ে থমকে আছি। মনিটরে মাঝেমাঝে ফেইটাল এরর হয়। গাঢ় চকচকে নীল পর্দা এসে সব ঢেকে দেয়। শাদা গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থেকে নির্মম পরিহাস। সকল চেষ্টা ফাঁকি দিয়ে মরে গেছে যন্ত্র। যন্ত্রেরও শরীর বিগড়ায়, মাথা নষ্ট হয়। মাথা মানে প্রসেসর, নয়তো মাদারবোর্ড। মা! মা! তোমার কী হয়েছে মা? মন খারাপ? মন খারাপ হলে আমাকে একটু জড়িয়ে থাকো। আরো একটু সময়… তোমার গায়ের গন্ধে একটা শৈশব ফেলে এসেছি আমি। মা!

নীল পর্দাটা তিরতির করে কাঁপছে। হাত চলে যাচ্ছে রিসেট বোতামের দিকে। চাপ দিলেই নিকষ কালো হয়ে উঠবে সব। সওব। তারপরে দমবন্ধ অনুভূতির অক্টোপাস, চেপে ধরে চারপাশ। নাগপাশ। হাঁসফাঁস। ফাঁসে ঝুলে গেছি আমি হ্যাং।

তারপরে বিপ বিপ করে আমার ধুকপুকানি ফিরে আসবে আমার, এবং আমার কম্পিউটারের। কম্পুসোনা চোখ খোলো। দেখো গাঢ় কোমল রাত জানালার বাইরে জমা হয়ে আছে। আলোগুলো অনেকেই একা একা তোমাকে দেখার জন্যে দূর থেকে এসেছে। তাদেরকে বিষণ্ণ করে দিও না। ওদের আলোটুকু উজ্জ্বল আর ভালো। তুমি ভালোমানুষের মতো জেগে ওঠো।

মা! আমার অনেক অনেক পাপ এই জীবনে। তুমি ছাড়া সেই কথা আমি আর কাকে বলবো। এই নষ্টতা ভ্রষ্টতার পৃথিবীতে জন্মের পর থেকে আমি পাপ করছি। সবাই বলে আমি অন্যায়ও করেছি অনেক। প্রথম প্রথম আমি ‘ভুল’ করতাম, তারপরে ‘কাজটা ঠিক করো নি’ বলতো সবাই। আরো কিছুদিন পরে বললো, ‘তুমি খুব খারাপ! এটা কী করে করলে? এ বড়ো অন্যায়’। একদিন সবাই খুব রেগে গেলো, ‘পাপী! নষ্ট! খারাপ! কুৎসিত!’ বলে তারা চেঁচিয়ে উঠলো, আমার চারপাশের বাতাসও থমকে গেলো। মনে হলো, সেদিন ফুসফুস ভরে উঠলো প্রাকৃতিক পাপে। আমি তো এরকম চাইনি। এভাবে সব ঘটে গেলো কীভাবে? আমাকে একটু জায়গা দিবে না মা? তোমার জঠরে ঢুকে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

মনের ওজন কতো? এতো কিছু বিজ্ঞান জেনে গেলো, অণুপরমাণুর ভেতরের বিদ্যা! আমাকে কেউ বললো না কতোদিন বাঁচলে মনের ওজন অসহনীয় হয়ে ওঠে? বললে আমি হয়তো সাবধান হতাম, সতর্ক হতাম যে আমি বিপজ্জনক হয়ে উঠছি। পাপবোধের ছুরি রক্তনালীর ভেতরে গুঁড়ো গুঁড়ো আফিমের মতো মিশে যাচ্ছে। তুমিও তো কিছু বলো নাই মা। আরেকটু হেসে আমাকে নিষেধ করতে! ‘বাবু, ওদিকে যেও না। আমার কথা শোনো। তাকাও এদিকে। ওখানে যেতে নেই।’ এভাবে বললেই আমি শুনতাম তোমার কথা। আমি তো তোমার লক্ষ্মীসোনা…

***
আমি এখনও নিথর মনিটরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছি। ঘরে কেউ নাই। ঘরের বাইরের লাইটগুলো নেভানো। চুপচাপ। এদিকে বাইরে জানালার বাইরে রাস্তায়ও কেউ নেই, কয়েকটা স্ট্রিট লাইট। ওগুলোকে এখন একলা একলা আর বিষণ্ণ লাগছে আমার। আর দেখো আমি মনিটরের দিকে তাকিয়ে হাসছি। স্ক্রিন-সেভারে জলজ মাতৃকায় একটা শিশু চোখ মুদে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি সেই শিশুটির মুঠো জড়িয়ে ধরলাম!

স্পর্শবিজ্ঞান

তোমাদের যেখানে মন চায় চলে যাও, আজ আমি কোথাও যাবো না। আজকের দিন হোক কেবলই আমার নিজেকে নিয়ে। আমি নিজের ভেতরে খুঁড়ে দেখবো কতোটুকু তোমরা ছুঁতেও পারো নি। আমি এতোদিন আগলে রাখতে পেরেছি! এতো এতো সংগ্রাম অর্থবোধক ভীষণ, আমি কাউকে ছুঁতেও দিবো না সেই কয়েকটুকরো হৃদয়ের জমিন।

কাউকে স্পর্শ করার কামনা কতোটা তীব্র হতে পারে? এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি কখনই ভাবি নি। আর ভাবি নি বলেই আমার জানা নেই স্পর্শ করার আকুতিতে মনের ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। বেশি না। শুধু হাতের আঙুলের আলতো ছোঁয়ার ইচ্ছার শক্তি এতোটাই! আমার বুকের ‘পরে পাথরের মতো চেপে বসতে পারে। মনে হতে থাকে চারপাশে কোথাও কোনো বাতাস নেই। আদিগন্ত ভ্যাকুয়াম। জ্যাজ!

তাই সেদিন থেকে আমি জানার চেষ্টা করি স্পর্শকামনা কেমন। ঠিক কতোটা বিচিত্রভাবে কাউকে স্পর্শ করা যায়! আমি কি শুধু হাসি দিয়ে কাউকে ছুঁয়ে দেয়ার দুরূহ কাজটা করতে পারবো? মুখের হাসি, চোখের হাসি, এগুলো শুনেছি প্রবল সংক্রামক। এক চিলতে হাসি অনেক সময় তলোয়ারের মতো ঝিকিয়ে উঠতে পারে। এই সত্য সম্ভাবনা, কারণ আমি এমন অসংখ্য হাসির কোপে কাটা পড়েছি অনেকবার। বহুবার! তারপর, অবাক হয়ে দেখেছি আমার ভেতরে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর কণার মতো ক্ল্যামেন্টাইনের হাসিমুখ। অথবা সুনয়নার, অথবা রাত্রির, হয়তো তোমার!

আমিও হয়তো ওর মতো, ওদের মতো হাসিতে স্পর্শ করতে পারবো যেমন আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে! তাই সেদিন থেকে আমার দিন রাত অবিরাম হাসিহুল্লোড়ে ভরে উঠলো। খলখল-ট্রেনে চেপে বসলো হাসির অমেয়কণিকা আমার… আমি বিস্ময়ে দেখি তারা কী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। তুমি দেখো না? তোমরা দেখো না? আমি আজ ঘরের ভেতরে গুটিশুঁটি খুব হাসছি অবিকল সেই শিশুটির মতো।

শিশুদের কথা আর না বলি? শিশুরা মোটেই ভালো নয়, তারা আমাকে ভুলে যাবে আর কিছু দিন পরেই। আমি জানি। সবাই তাদের বড়ো হয়ে ওঠার গল্প করবে আর এক ফাঁকে টুপ করে ঝরে পড়বে আমার একলা ঘরে বসে থাকার গল্পটা। ধুলোয় মিশে মিশে ওটার চেহারা আর চেনাই যাবে না। তারপরে একদিন জমাদারের ঠেলাগাড়িতে করে আমি হারিয়েই যাবো নির্ঘাত! উহ!

ওই ক্লিষ্ট খিন্ন মুখের দল। হা করে না থেকে আমার কথা শোনো। কান পেতে শোনো আমি হাসছি গ্রামারবিহীন। তোমরা বিরক্ত না হয়ে খেয়াল করলেই দেখবে আমার হাসির শব্দ আর গমক তোমাদের কোষে কোষে ঢুকে গেছে। অমল শিশুগুলো হাসছে, তাদের ওপরে আমার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ নেই কিন্তু!

কিন্তু আমি আদতে চাইছিলাম কাউকে স্পর্শ করতে, এমনভাবে ছুঁয়ে দিতে যেন সে একটুকরো রুমালের মতো আমার ছোঁয়াটুকু নিয়ে চলে যেতে পারে। সে আমাকে ভুলে গেলেও তার ভেতরে, বাইরে আমার দেয়া আঙুলের ছাপ থাকবে। ছাপ মুছে গেলে উত্তাপ থাকবে। উত্তাপও যেদিন চলে যাবে সেদিন হয়তো আমিই থাকবো না, তাই না?

কলমে আর পেন্সিলে লিখছিলাম। কাগজ আর শীষের শীর্ষের কত গভীর ছিনিমিনি প্রেম। আঠারো আর একুশের প্রেম যেমন! ষোলো আর বিশের প্রেম যেমন। চকিত আর ক্ষণিকেই বুকে গেঁথে ফেলে একশ’ গোলাপ। সুবাসটুক বুক পকেটে নিয়ে অযথাই একুশ আর বিশ ঘুরে বেড়ায়। আঠারো আর ষোলোর কামিজপ্রান্তে তাদের গুমখুনের খবর কেউ জানতে পারবে না। কোথাও কোনো মামলা দায়ের হবে না। খালি বাদী-বিবাদীরা নিরন্তর ক্ষয়াটে এই গ্লোবে আরেকটু সবুজ হয়ে উঠবে। আরেকটু নীল করে তুলবে আমাদের আকাশ। কলম-পেন্সিল আরও কতো কী করে কাগজের বুকে। আমার অক্ষমতা যে আমি তা পুরো বুঝে উঠতে পারি না কখনোই!…