জাবালে নূর

by Anik Andalib

There has to be spiritual transformation among the masses, who have to be willing to recognize that their oppression is not a law of nature.

উপরের কথাটা নোম চমস্কির। লাতিন আমেরিকার দশকের পর দশক ধরে চলে আসা শোষণ নিপীড়ন আর নাগরিক বঞ্চনা, নারীদের ভোটাধিকার-সম্পত্তির অধিকার-চাকরি করার অধিকার, এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ‘সিভিল রাইটস’ আন্দোলন নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি এই কথাটা বলেছিলেন। একটা বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মিক/আধ্যাত্মিক/দার্শনিক পরিবর্তন আসতে হবে। জনগোষ্ঠীর ভেতরে যেন সবার মনে একই কথা (একটু এদিক ওদিক করে) ঘোরে, যেন সবাই একই জিনিস কামনা করে, যেন সবাই নিজেদের বন্দিত্বকে একইভাবে চিনতে পারে – সেই আন্দোলন আর সবকিছুর চেয়ে বেশি জরুরি। বাকি সমস্ত মিছিল মিটিং জ্বালাও পোড়াওয়ের এক পয়সা মূল্য নাই।

এই কথাটার জন্য গালি খেতে হবে। তাও বলছি। নব্বুইয়ের স্বৈরাচার পতন নিয়ে আমার চেয়ে বছর দশেক বড় যারা তারা সবাই খুব গর্ববোধ করেন। স্বৈরাচার পতন হয়েছিল। আচ্ছা, তারপর কী হয়েছে বলেন তো? কী ঘোড়ার ডিমটা ফলেছে? বিশ্ববেহায়াটা সংবিধানের বারোটা বাজিয়েছিল, ঠিক করতে পেরেছে কেউ? প্রথম যে সরকার এনেছিলেন সে সময়ের নাগরিকরা, সেই সরকারের আমলে গণ-আদালত বসেছিল, সেখানে শেষ বিচারে গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে ড্যাংড্যাং করে বেরিয়ে গেছে। ঠেকাতে পেরেছেন? বদলাতে পেরেছেন? পারেন নাই।

আমার বড়বেলায় দুটা আন্দোলন দেখেছি, একটা বুয়েটের ভিসিবিরোধী আন্দোলন, আরেকটা শাহবাগের গণজাগরণ আন্দোলন। প্রথমটা পুরোপুরি ব্যর্থ। দ্বিতীয়টা সাময়িক ও প্রাথমিক অর্জনের পর সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও ব্যর্থ।

এই তিনটা আন্দোলনের সব কয়টা কেন ব্যর্থ হলো? নানাজনে নানা কারণ বলবেন, আমার মতে সেগুলো সবই উপরি-কারণ। বাহ্যিক কারণ। ভাসাভাসা চোখে দেখলে সেগুলোকে ঠিক মনে হবে। এর বেশি ভাবতে গেলে আপনাদের মস্তিষ্ক ব্যথা করবে। আমি মনে করি এই প্রত্যেকটা আন্দোলন ব্যর্থ হবার পেছনে প্রধান কারণ এই সামগ্রিক দার্শনিক পরিবর্তনের অভাব। আমাদের কারোর মাঝে বদল আসে নাই। আমরা কোনো ব্যবস্থাকেই বদলাতে পারি নাই। এক স্বৈরাচার সরিয়েছি কিন্তু অন্য কেউ যেন স্বৈরাচার না হতে পারে আর কখনো – সেটা আমরা নিশ্চিত করি নাই। একটা ভিসি সরে নাই, ভাল কথা। পরের ভিসিগুলো যেন অমন না করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে পারি নাই। এক কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু তার বিনিময়ে আরো কয়েকজন ব্লগার খুন হয়েছে। দেশে চুপচাপ ইসলামিক জঙ্গিবাদের বাম্পার ফলন ঘটেছে – আমরা সেটাকে চিহ্নিত করে বাতিল করতে পারি নাই।

আমাদের কোনো একটা ব্যবস্থাকেও ঠিক করতে পারি নাই – রাজনৈতিক, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, সামাজিক – প্রত্যেকটা ব্যবস্থা নষ্টভ্রষ্ট। আজকে শিশুরা রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদেরকে সবাই বাহবা দিচ্ছেন। তারা রাজনৈতিক বা দার্শনিক প্রজ্ঞা ধারণ করে না। তা, আপনি করেন? এই আন্দোলনের ফলাফল কেমন আশা করেন? কী কী বদল ঘটবে? এখন যদি বলেন, কিছুই বদলাবে না তবু একটু ভাঙচুর হলো, সবাই জানলো যে আমরা আছি, তাহলে আপনি সেই তৃপ্তি নিয়ে হাল্কা মুতে শুয়ে পড়েন।

দুঃখিত এমন ভাষায় কথা বলার জন্য। কিন্তু এমন অবিমৃশ্যকারিতা দেখে মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল। আপনি কি ভাবছেন আপনার একারই আবেগ আছে, আপনার আবেগ কি যাদের সন্তান মারা গেছে তাদের চেয়েও বেশি? আবেগ দিয়ে কাচকলাটাও হয় না। ওটা বাদ দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা হলে চিন্তা করেন। গত কয়েকদিন ফেসবুকে ডাঃ মণীষার পক্ষের প্রচারণা দেখেছি। আজকে ভোটকেন্দ্রগুলোতে কী হয়েছে দেখেছেন তো? যারা গিয়ে মণীষাকে আঘাত করেছে, ভোট চুরি করেছে, এক দলের স্লোগান দিয়ে নাকি অন্য দলের ব্যালট ভরেছে – এরা আপনার আমার ভাই। এই ভাইদের পারলে লাইনে আনেন। তারপর সবাই মিলে আঙুল তুলে ‘বি কেয়ারফুল’ বলা মাস্তানকে হঠাতে পারবেন। আপনাকে তখন আলাদা করে কিছু করতে হবে না, সবাই মিলেই করবে।

আজকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের সব অভিভাবকের কাছে ক্ষুদেবার্তা গিয়েছে – আপনার সন্তানকে সামলান, সে এই আন্দোলনে গেলে তাকে বহিষ্কার করা হবে। এই বার্তাকে উপেক্ষা করে যদি সব অভিভাবক কালকে তাদের ছেলে মেয়েকে আন্দোলনে পাঠান, আদমজী কি সবাইকে বহিষ্কার করবে? কিন্তু তা ঘটবে না। কারণ উপরে নোম চমস্কি বলে দিয়েছেন। এই আপামর জনসাধারণের মধ্যে এই চেতনা নাই যে কোনো স্কুলের অধ্যক্ষ এভাবে অভিভাবকদের শাসাতে পারে না। তারা যে বন্দী, নিপীড়িত, সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাই। সুতরাং বাকি কয়েকজন মিলে রাস্তায় নেমে কোনো লাভ নেই। যারা নামবেন, তারা মার খাবেন, মারা যাবেন। বাকিরা সুখে বার্গার চিবাতে চিবাতে সেলফি তুলবে।

আমাদের প্রতিটা আন্দোলন গুটিকয় মানুষের, সেই মুক্তিযুদ্ধ থেকেই। তার আগেও অমনই ছিল। সামগ্রিক জাগরণ আমাদের আসে নি, তাই আমাদের মাঝে ধারণা নেই যে নাগরিক মানে কী, দেশ মানে কী, জাতি মানে কী, সরকার মানে কী। এগুলো ধারণা নাই বলে অন্যায় হয়, আমরা তড়পাতে তড়পাতে কয়েকটা বাস পুড়াই, তারপর পুলিশ আর র‍্যাবের ঠ্যাঙানি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই পরের ঘটনা পর্যন্ত।